6534
Published on সেপ্টেম্বর 9, 2018ড. জাহাঙ্গীর আলম:
ষাটের ও সত্তরের দশকে আমাদের কৃষির অবস্থা কেমন ছিল? ভাবতে গেলে খুবই একটা দীনদশা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঘরে ঘরে ছিল ভাতের অভাব। একজন শ্রমিক সারাদিন কাজ করে যে মজুরি পেত তাতে ৩ কেজি চাল কেনারও সামর্থ্য হতো না। এখন আর সেই অভাবের দিন নেই। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল ৩ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক কী শ্রমিক কারোই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষিখাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। কৃষির উৎপাদনে এসেছে বহুমুখীনতা। শুধু ধানের উৎপাদনই নয়, বেড়েছে শাকসবজি, ফলমূল, ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের উৎপাদন। বাজারে অভাব নেই কোনো কৃষিপণ্যের। প্রতি বছর এদেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তার পরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং বাড়ছে নিরন্তর। তার কারণ নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষিখাতে। আগের খোরপোষ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে।
গত ৪৭ বছরে এদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। বেড়েছে শাকসবজির উৎপাদন। রাজধানীর অদূরে সাভার কিংবা জয়দেবপুর গেলেই চোখে পড়ে সবজিতে ভরা মাঠ। নরসিংদী কিংবা উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পথের উপর গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সবজির পাইকারি বাজার। স্থানীয় বাজারগুলোতে যে সবজি ও ফলমূল পাওয়া যায় তা এখন শুধু দেশের চাহিদাই মেটায় না, বিদেশেও রপ্তানি হয়। বছরের পর বছর আমাদের রপ্তানি আয় বাড়ছে শাকসবজি ও ফলমূল খাতে। আগে বিদেশে রপ্তানি করা হতো শাকসবজি ও কলা। এখন তাতে যুক্ত হয়েছে আম। বর্তমানে আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিরায়তভাবে গড়ে ওঠা রাজশাহী নবাবগঞ্জ ও দিনাজপুরের বাগানগুলো ছাপিয়ে এখন প্রচুর আম ৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায়। তাছাড়াও বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধানি জমি পরিণত হয়েছে আম বাগানে। এক বিঘায় ধান উৎপাদনে লাভ হয় প্রায় ১৫শ টাকা। কিন্তু আম উৎপাদন করলে লাভ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে নতুন ফল স্ট্রবেরি। তাতে লাভ হচ্ছে বিঘাপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এগুলো উদাহরণ মাত্র। তালিকায় আছে অনেক ফল, অনেক সবজি। এর কারণ কৃষিতে এগিয়ে আসছে অনেক নতুন উদ্যোক্তা। বয়সে এরা তরুণ। এরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ক্ষেত করছে সবজির। গড়ে তুলছে ফলের বাগান। তাছাড়া এরা বিনিয়োগ করছে মত্স্য, পোল্ট্রি এবং দুগ্ধ খামারেও। সম্প্রতি বাংলাদেশ মত্স্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা করা হয়েছে। স্বয়ম্ভর হয়েছে মাংস উৎপাদনেও। ডিম ও দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এ দুটো পণ্যেরও ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই।
খাদ্যশস্য ও সবজির পর আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি চোখে পড়ার মতো। আমাদের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম। কিন্তু জনপ্রতি বর্তমান প্রাপ্যতা প্রায় ১৭০ গ্রাম। বর্তমান শতাব্দীর গোড়ার দিকে আলুর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় অর্ধ কোটি টন। এখন তা ১ কোটি ৫ লক্ষ টন। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। প্রতি বছর আলু রপ্তানি করে আমরা আয় করছি প্রায় শত কোটি ডলার। তাছাড়া আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপস এবং পটেটো ক্রেকার্স হিসেবে অনেক সমাদৃত।
এদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। দীর্ঘমেয়াদে এর আবাদি এলাকা কমেছে। তবে একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিন রহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরো সুগম হয়েছে। ২০০২ সালে আদমজী জুট মিল বন্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অন্ধকারে প্রবেশ করেছিল আমাদের পাট শিল্প। অতঃপর বিভিন্ন ইতিবাচক নীতিমালা গ্রহণ এবং চাষিদেরকে মূল্য সমর্থনের মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকার চিরে ক্রমেই আলোর দিশা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশ্ববাজারে অদূর ভবিষ্যতে পাটের চাহিদা বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের পাটের রপ্তানি আয়।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক ভূমিকা রেখেছে পুঁজি গঠন। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে এদেশে বিতরণকৃত মোট কৃষিঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কৃষিঋণের সুদের হার নামানো হয়েছে ৯ শতাংশে। মসলা ফসলের জন্য ঋণ দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে। দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য ঋণের সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশে। এছাড়া পোল্ট্রি ও মত্স্য খামার গড়ার জন্যও প্রদান করা হচ্ছে উদার ঋণ সুবিধা। তাছাড়া কৃষি বিপণন ও কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্যও ঋণের বিশেষ সুবিধা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ঋণের প্রসার ঘটেছে মাত্র প্রায় ৪০ লক্ষ কৃষি পরিবারে। আরো প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ কৃষক পরিবার কৃষিঋণের আওতাভুক্ত নয়। এরা আর্থিক প্রয়োজন মেটায় অপ্রাতিষ্ঠানিক উত্স থেকে। এদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষিঋণের আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
আমাদের দেশে এখন কৃষিঋণের আওতা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে কৃষিতে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন। এর আওতাভুক্ত রয়েছে সবজি, ফলমূল, সুগন্ধি চাল, দুধ, ডিম, মাছ, ভুট্টা ইত্যাদির উৎপাদন। এক সময় পাটের উৎপাদনও হতো চুক্তির ভিত্তিতে। অর্থাত্ কৃষকের সঙ্গে ক্রেতার পণ্য বিক্রির আগাম চুক্তি। তাতে আগেভাগেই পণ্যমূল্য নির্ধারণ করা থাকে। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই লাভবান হয়। সময়মতো পণ্য সংগ্রহ করা যায়। মানসম্মত পণ্য প্রাপ্তিরও নিশ্চয়তা থাকে। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির জন্য চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে। বর্তমানে জৈব কৃষি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক কৃষির উৎপাদন জৈব কৃষির নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ বিষয়ে একজন উদ্যোক্তা বলেছেন, অর্থায়ন নিশ্চিত করার কথা। বলেছেন সরকারি সহায়তা প্রদানের কথাও। এখানে কৃষিঋণের ভূমিকাই মুখ্য। এ বিষয়ে আমাদের ব্যাংকিং খাত খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।
কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। ভূমি কর্ষণ, আগাছা পরিষ্কার, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধান ভানা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে এসেছে। বেড়েছে যন্ত্রের ব্যবহার। একসময় ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো লাঙ্গল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে ৫ শতাংশে। বাকি ৯৫ শতাংশই যন্ত্রশক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ চলছে। ধান কাটা ও মাড়াই ক্ষেত্রে যন্ত্রশক্তির ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। কিন্তু তার পরিধি খুবই সীমিত। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উত্সাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ ৭০ শতাংশ। তবে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। এটি বাছাইকৃতভাবে এখনো কার্যকর হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চলছে শ্রমিক সংকট। তাতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তদুপরি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে সময় ক্ষেপণ, অপচয় ও অদক্ষতার কারণে কৃষির উৎপাদনে লাভজনকতা কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কৃষি যন্ত্রের উপর ভর্তুকি সার্বজনীন ও উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তাতে যেকোনো কৃষক তার প্রয়োজন অনুসারে ভর্তুকি মূল্যে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হবে।
কৃষি উন্নয়ন ত্বরাম্বিত করার জন্য গত ১০ বছরে এদেশে প্রণীত হয়েছে অনেক নীতিমালা। এর মধ্যে জাতীয় কৃষিনীতি, কৃষি সম্প্রসারণ নীতি, কৃষি উপকরণ নীতি, পোল্ট্রি নীতি, পশুসম্পদ উন্নয়ন নীতি ও মৎস্য নীতি অন্যতম। এগুলোর কলেবর বিশাল। এতে সংযুক্ত করা হয়েছে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়। এর মধ্যে প্রধান হাতিয়ার ৩টি। এগুলো হচ্ছে কৃষি ভর্তুকি, পণ্যের নিম্নতম মূল্য নির্ধারণ এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আরোপ। এগুলোর মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল বরাবরই ছিল ইতিবাচক। কৃষি ভর্তুকির ক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৩ ধরনের প্রক্রিয়া চালু আছে। এর মধ্যে আছে কর হ্রাস, বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে উপকরণ প্রদান এবং সরাসরি নগদ ভর্তুকি। বাংলাদেশে প্রথম দুটো প্রক্রিয়া চালু আছে দীর্ঘদিন ধরে। শেষোক্ত প্রক্রিয়াটি চালু হয়েছিল বর্তমান মহাজোট সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর। এর জন্য ১০ টাকা জমার বিনিময়ে ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয়েছিল কৃষকদের জন্য। তার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। ঐ সময় কৃষকদেরকে নগদ সহায়তা প্রদানও করা হয়েছিল একবার। পরে অবশ্য তার আর পুনরাবৃত্তি হয়নি। কৃষিখাতে নগদ ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি খুবই স্বচ্ছ এবং উৎপাদন সহায়ক। কোনো ফসলের উৎপাদন বাড়াতে অথবা কোনো ফসলের উৎপাদন কমাতে এই ভর্তুকি খুবই কার্যকর। এ নীতির স্থায়ী প্রত্যাবর্তন দরকার।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ