আগস্ট বাঙালির বেদনার মাস

12900

Published on আগস্ট 9, 2018
  • Details Image

ফারুক মাহমুদঃ

বেদনা আর শোকের ঘটনার দুর্বহ স্মৃতি নিয়ে হাজির হয়েছে আগস্ট। কমবেশি বেদনাবিধুর ঘটনার স্মৃতি প্রত্যেক মাসেই থাকে। কিন্তু আগস্ট যেন বেদনায় ঠাসা মাস। কিছু বেদনাবৃক্ষ রোপণ করেছে নিষ্ঠুর-নির্দয় মানুষ, আর কিছু ঘটেছে সময়ের নিয়মে। কথায় আছে, ‘অল্প শোকে কাতর, আর বেশি শোকে পাথর’। আগস্ট মাসে এত শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে, বাংলাদেশের মানুষ, আগস্ট এলে শোকে পাথর হয়ে যায়। অশ্রু যেন বাঁধ মানে না।

এই আগস্টে ঘটেছে মর্মন্তুদ কয়েকটি ঘটনা, আমাদের শোকসাগরে ভাসিয়ে অনন্ত জীবনে চলে গেছেন অনেক প্রিয়জন। চলতে চলতে মহাকালের চাকা ক্ষণিকের জন্য হলেও যেন থমকে যায় আগস্ট মাস অতিক্রমের সময়, বাংলাদেশের মানচিত্রে নেমে আসে শোকের ছায়া, বাঙালির হৃদয়ে আছড়ে পড়ে বেদনার ঢেউ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন নির্মম, নিষ্ঠুর বর্বর, পৈশাচিক ঘটনার নজির খুব একটা পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ বেদনার্ত হয়ে পড়েছিল নরপশুদের দাম্ভিক উন্মত্ততায়।

গত শতাব্দীর একাত্তর সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ‘পোড়ামাটি’ নীতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরস্ত্র মানুষের ওপর। নারকীয়তা তাণ্ডবে তারা বাংলাকে ছাইঢাকা, বিরাণভূমিতে পরিণত করতে চেয়েছিল। কিন্তু বর্বরতার আঘাতগুলো হানাদারদের জন্য বুয়েরাং হয়ে দাঁড়াল। ‘নিরীহ বাঙালি’ বলে এই জনপদের মানুষের যে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি ছিল, তা থেকে বাঙালিকে বেরিয়ে আসতে হলো। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সামনে যাওয়া ছাড়া যেমন কোনো পথ থাকে না, বাঙালির তাই হলো। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, জনপদের পোড়া ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ঝলসে উঠল বাংলার মানুষ। তথাকথিত দুর্ধর্ষ, যুদ্ধবাজ পাকবাহিনীকে পরাজিত করতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্র নয় মাসে প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। বাস্তবতার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, তাদের এ দেশীয় অনুচররা পরাজয় মানলেও পরাজয়ের গ্লানি ও জ্বালা ভুলতে পারেনি। ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ যখন উঠে দাঁড়িয়েছে, বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির বিজয় সরণি যখন নির্মিত হচ্ছে, তখনই পরাজিতরা বিষাক্ত ছোবলটি হানল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার অংশ হিসেবে হত্যা করা হলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা এতটাই উৎকট ছিল, ঘাতকের বুলেটের নির্মমতা থেকে বঙ্গবন্ধু স্বজনদের কেউ রেহাই পায়নি। নারী-শিশুদের প্রতি মানবিক আচরণের যে রীতি রয়েছে সভ্য সমাজে, এ ক্ষেত্রে এরও পদদলন ঘটল। ধানমণ্ডি ‘বত্রিশ নম্বরে’ অকল্পনীয় নির্মমতায় হত্যা করা হলো বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধু অনুজ শেখ নাসের, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রাসেল এবং কামাল-জামালের নববিবাহিত স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। ঘাতকরা এতটাই পাষণ্ড পশু হয়ে উঠেছিল, শিশু রাসেলের বেঁচে থাকার কাকুতি বুলেটের শব্দে স্তব্ধ করে দিতে তারা সামান্য বিচলিত হয়নি। বিদেশে থাকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। ষড়যন্ত্র এবং হন্তারকদের উন্মত্ততার আগুন এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল, এরা অদূরে থাকা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাদ, তার পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আরজু মনিকেও হত্যা করে। ১৫ আগস্টের এই বর্বরতা শুধু কয়েকজন বিপদগামী উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার দলবদ্ধ আস্ফালন ছিল না, এর পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে সরকারের পরিবর্তন আনাই শুধু নয়, পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বাংলাদেশের যাত্রাপথ ঘুরিয়ে দেওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ১৫ আগস্টের ভোরেই হত্যার করা ‘জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এবং বাংলাদেশ বেতার পাল্টে করল রেডিও বাংলাদেশ (পাকিস্তান জিন্দাবাদ এবং রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে)। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফনের আগেই তারই আশেপাশে থাকা মুখোশধারী ‘আওয়ামী লীগ’ নেতারা খুনি মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। রচিত হলো ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার এক ধূসর ইতিহাস। বাংলার মানুষের চোখের মণি, যিনি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করতেন বাংলার ধূলি-মাটি-ঘাস। বাংলার ধূলি-মাটি-ঘাস, তার জীবনপ্রদীপ নিভে গেল বিপদগামী কতিপয় বাঙালির হাতে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, কী নির্ভয়ে, প্রায় প্রতিরক্ষাহীন থাকতেন নিজের বাড়িতে। সিংহ-হৃদয়ের এ মানুষটি কি কখনো ভেবেছেন বাঙালির কোনো সন্তান তাকে হত্যা করতে পারে। ভাবেননি। যার জীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত, তাকে কে আঘাত করবে। আঘাত করেছে বাংলার আলো-জলে বেড়ে ওঠা মানুষরাই। ১৫ আগস্ট বাঙালির হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার নয়। তবে এ কথাও সত্য, ব্যক্তি মানুষকে হত্যা করে তার আদর্শ, তার কীর্তি ধ্বংস করা যায় না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন তার অমূল্য দেশপ্রেম এবং মানবকল্যাণের মহান আদর্শের জন্য।

যে কোনো হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার হবে, এটাই সভ্য সমাজের বিধান। কিন্তু বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, এর কোনো বিচার হলো না। উপরন্তু, যারা হত্যাকাণ্ড ঘটাল, তাদের পুরস্কৃত করা হলো। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কত নাটকই না করল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় এলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হলো। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে হন্তারকদের বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে জাতি কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত কয়েকজন খুনি এখনো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারে রায় কার্যকর করা গেলে জাতির ললাটে লেপ্টে থাকা কলঙ্কের দাগ সম্পূর্ণ মোচন হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচারের একটি ফলক। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটেছিল একটি জঘন্য, মর্মান্তিক ঘটনা। ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে পূর্বপরিকল্পিতভাবে চালানো হয় গ্রেনেড হামলা। নৃশংস এই হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে মানবপ্রাচীর গড়ে তুলে রক্ষা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে। ন্যক্কারজনক এই গ্রেনেড হামলার সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ক্ষমতাসীনরা এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নানা মিথ্যাচার ও নাটকের অবতারণা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে এই হত্যাকাণ্ড তদন্ত নতুন করে শুরু হলে বেরিয়ে আসে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা। মামলার অভিযোগপত্রে ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাঘববোয়ালের নাম উল্লেখ রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের সুস্পষ্ট ধারণা, এই বর্বর ন্যক্কারজনক জঘন্য হামলাটি চালানো হয়েছিল জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ১৪ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে মামলাটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই রায় হবে। গ্রেনেড হামলায় অংশগ্রহণকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের মধ্য দিয়ে ন্যায়বিচারের ইতিহাসে আরও একটি উদাহরণ স্থাপিত হবে, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

আগস্ট মাস বাঙালির জন্য একটি বেদনাবিধুর মাস। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হালার ঘটনা ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ভয়াবহ, অমানবিক প্রকাশ। দুটো ঘটনায় ইতিহাসের মহানায়ক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান যেমন আছেন, আছেন সাধারণ মানুষ। এই আগস্টে ঘটেছে অনেক প্রিয় মানুষের প্রয়াণ। এদের মধ্যে আছেন কবি, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতাসহ অনেকে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির নবনির্মাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আগস্ট মাস, অর্থাৎ ২২ শ্রাবণ মহাপ্রয়াণে যান। মানুষের জীবনের সব অনুভূতির কাব্যিক উপস্থাপনা ঘটেছে তার কবিতায়, গানে। তার গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ-পত্রসাহিত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই আগস্ট মাসেই প্রয়াণ ঘটেছে আমাদের জাতীয় কবি, রণসংগীতের রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলামের। বিদ্রোহী কবির পরিচিতি নিয়ে এই কবি বাঙালির মনে চিরজাগরুক। তার গান, কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রেম আর দ্রোহের বাণীতে বিস্তৃত। এই আগস্ট মাসে আমরা আরও কয়েকজন কবিকে হারিয়েছি। সমকালীন বাংলা কবিতার কিংবদন্তিতুল্য কবি শামসুর রাহমানকে আমরা এ মাসেই হারিয়েছি। ‘ইতিহাসের কবি’ হিসেবে গৃহীত হওয়া এই কবি বাংলা কবিতায় যে ধারাটি তৈরি করেছেন, এটি অভিনব সার্বভৌম। নাগরিক চেতনার কবি শহীদ কাদরীকে হারালাম আগস্ট মাসেই। বহুমাত্রিক লেখা হুমায়ুন আজাদের প্রস্থান ঘটেছে এ মাসেই। বাংলা গানের কৃতী শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, নায়করাজ বলে খ্যাত রাজ্জাক বিদায় নিয়েছেন আগস্ট মাসেই। প্রতিভাবান চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রয়াত হন আগস্ট মাসে।

বাঙালির রোদনের মাস, বেদনার মাস আগস্ট বর্ষা ঋতুর অংশবিশেষ। থেমে-থেমে, থেকে-থেকে বৃষ্টিঝরা এই সময়টায় বাংলাদেশের মানুষ হারিয়েছে তাদের প্রিয় অনেক মানুষ। তাদের বিয়োগবেদনায় যেন বাতাস ব্যথিত হয়, আকাশ কাঁদে।

লেখকঃ কবি ও সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত