4509
Published on জুলাই 22, 2018সাহাবুদ্দিন চুপ্পুঃ
আঁধার যত গাঢ় হয়, তারার উজ্জ্বলতা তত বাড়ে। প্রতীকী অর্থে বলতে গেলে আজ থেকে ৯ বছর আগে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের দুঃশাসন এবং পরবর্তীতে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃত্বে দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে যখন অন্ধকার নেমে এসেছিল; ঠিক তখনই ২০০৯ সালে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে তারার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। নতুন শতাব্দীতে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো মূলত সেখান থেকেই; যা গত কয়েক বছর ধরেই চলছে। যদিও ৯ বছর খুব বেশি সময় নয়; অথচ এ সময়েই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব সূচকে যেভাবে তিনি অগ্রগতি, সাফল্য আর উন্নয়নের ফানুস উড়িয়েছেন; তাতে সহজেই অনুমেয় আগামীর বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশের সারিতে কাঁধ মেলাতে সক্ষম হবে।
দুই. মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশ কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল—শেখ হাসিনার সেই তত্ত্ব বুঝতে হলে আরেকটু পেছনে যেতে হবে। তিন দশক আগে নিজের জীবন-সংগ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজের ‘ওরা টোকাই কেন’ গ্রন্থে শেখ হাসিনা লিখেছিলেন, ‘আমার চলার পথটি কখনই সহজ নয়। বহু চড়াই-উতরাই পার হতে হচ্ছে। নানা সমস্যা চোখে পড়ে। দুঃখ-দারিদ্র্যক্লিষ্ট আমাদের সমাজজীবনের এই দিকগুলো সবাই চিন্তা করুক। সমাজ ও দেশ উন্নয়নের কাজে রাজনৈতিক ও মানবিক চেতনায় সবাই উজ্জীবিত হয়ে উঠুক, এটাই আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা’ (১৯৮৯ সাল)। একই গ্রন্থের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘দেশ ও জনগণের জন্য কিছু মানুষকে আত্মত্যাগ করতেই হয়, এ শিক্ষা-দীক্ষা তো আমার রক্তে প্রবাহিত।’ বাক্য দুটিতে শেখ হাসিনার দুই জীবনোদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল। এক, মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সবাইকে নিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন। দুই. দেশকে ভালোবেসে প্রয়োজনে জীবন দান করা। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই দুটো ইচ্ছাই ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে, ১৯৮৯ সালে। বিশ্বাস করি, এমন দূরদর্শিতার কারণেই ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছিল। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে সে সময়ে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ছিল ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করার পদক্ষেপেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। এ বিষয়ে নেওয়া কার্যক্রমের মধ্যে ছিল- দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প।
বঙ্গবন্ধুকন্যার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) ক্ষমতাগ্রহণ-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্রটি ছিল আরও উজ্জ্বল। এ সময় শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬.৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষিদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪ থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনার শান্তির মডেল গ্রহণ ইত্যাদি।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর পর বাংলাদেশ পেয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। ঝুলিতে পুরেছে ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থলসীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন, (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস এবং ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এসব কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে শেখ হাসিনা যে পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছেন, তার ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম।
তিন. তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোয় দুটো জিনিসের বড় অভাব। এক. সৎ ও সততার চর্চাকারী সাহসী রাজনীতিবিদ। দুই. উন্নয়নের ধারবাহিকতা। জীবদ্দশায় জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল আশাবাদ রেখেছিলেন, ‘পরম প্রত্যাশায় আছি, শেখ হাসিনা মৃত্যুর ভয়ে পশ্চাৎপদ হননি। সাহসের সঙ্গে সংগ্রামে এগিয়ে অগ্রবর্তিনী হয়ে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন আর ঘাতক মূষিক গোপন থেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পদদলিত হওয়ার আশঙ্কায় কৃমিকীট হয়ে আত্মগোপন করেছে।’ সম্ভবত এ কারণেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঈশ্বর না থাকা দুঃখিনী জনপদ সর্বনাশা পদ্মায় সাহসী স্বপ্নযাত্রার রোডম্যাপ এঁকেছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর বিশাল এ প্রকল্প হাতে নেওয়ার ঘটনা অনেক দেশ ও সংস্থা এবং সরকারের মধ্যেও কোনো কোনো নীতিনির্ধারক সন্দেহ ও বিস্ময় প্রকাশ করলেও সে স্বপ্ন এখন দৃশ্যমান। সর্বশেষ তথ্য মতে, ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর কাজ ইতিমধ্যেই ৬২ শতাংশ শেষ হয়েছে (একাত্তর টিভি)। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বড় বড় প্রকল্প নিয়ে তার (শেখ হাসিনা) সাহসী সিদ্ধান্তগুলোও বেশ প্রশংসার দাবিদার। এর মধ্যে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে বাংলাদেশ। গত বছরের ৩০ নভেম্বরের পর থেকে দেশ এখন বিশ্বের ৩১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকায়। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগও চলমান। রয়েছে মহাকাশ জয়ের মতো বিশাল অর্জন। দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ গত ১২ মে উেক্ষপণ করা হয়েছে। ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ উপগ্রহ সফলভাবে মহাকাশে যাওয়ায় বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হয়েছে বাংলাদেশ। তার আমলেই আমাদের গড় আয়ু ৭১ বছর হয়েছে; মৃত্যুর হার কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। সাত বছর ও তার বেশি বয়সের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশই শিক্ষিত; তারা সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার দৌড়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছেন ভারত ও পাকিস্তানের আগে (আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘প্লোবাল পিস ইনডেক্স’-এর তালিকা অনুসারে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ৮৪ নম্বরে; যেখানে ভারত ১৪১ এবং পাকিস্তান ১৫৩ নম্বরে রয়েছে)। এ ছাড়া মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসসহ আরও কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। কোনো রকম যুদ্ধ-সংঘাত বা বৈরিতা ছাড়াই দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের বিপক্ষে সমুদ্র বিজয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি টেরিটরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকার প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা পেয়েছে বাংলাদেশ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি। তলাহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার দায়িত্বও পালন করছে।
১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘...সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না— চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ।’
বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা তার সুযোগ্য কন্যা অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করেছেন। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে শেখ হাসিনা আজ সর্বজনকে নিয়ে বিজয়িনী হয়েছেন ঠিকই; কিন্তু এর বাস্তবতা ও সত্যতা বিরোধী সুশীলদের একগোষ্ঠী ও একশ্রেণির বিরোধী রাজনীতিক স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন। দরিদ্র বিশ্বকে স্বপ্ন দেখানোয় তিনি যখন আশাজাগানিয়া সুর তুলেছেন, চিন্তাভাবনায় মুগ্ধ হয়ে ত্রিদিব দস্তিদাররা যখন তাকে ‘আপনিই (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশ’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন, মানবিক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলে বহুত্ববাদী বাংলাদেশের পতাকাকে মেলে ধরেছেন। ঠিক তখনই কোনো কোনো টেলিভিশন-পত্রিকায় কে কার চেয়ে সরকারের বড় সমালোচক, অন্তহীনভাবে সেই অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে।
’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালীন ’৭১-এর পরাজিত শক্তি ও ’৭৫-এর ঘাতকদের সমর্থক বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে জঙ্গিবাদের উত্থানকে শেখ হাসিনার সরকার কঠোর হস্তে দমন করেছে। পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দৃঢ়তায় আজ সাময়িক নিষ্ক্রিয় হলেও তারা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
যে কোনো মূল্যে এই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ ও নির্মূল এবং অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বজায় রাখতে হলে প্রয়োজন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত সরকারের ধারাবাহিকতা। এটাই এখন দেশপ্রেমিক জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও সময়ের দাবি।
লেখক : সাবেক পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন