6296
Published on জুলাই 8, 2018মীর আব্দুল আলীমঃ
দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এক অনুকরণীয় নাম। এত দিন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখ থেকে কথাটি শোনা গেলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। সংস্থাটি বলেছে, সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগ আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে হতদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সংখ্যায় বললে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ অতি দরিদ্র এখন। অথচ ২০০৫ সালে এ হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। অর্থাত্ প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশি ছিল অতি দরিদ্র। ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন আপডেট’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলনের চেয়ে আরো কম। এই হার ১১.২ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অতি দরিদ্রের হার কমে আসার মূল কারণ। সরকার গত ছয় বছরে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক-নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। শহর কি গ্রামে সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এখন কৃষক তার উত্পাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারণে অতি দরিদ্রের হার কমে এসেছে। লক্ষণীয় বিষয় যে, কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে অতি দরিদ্রের হার কমছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে এ হার ছিল ১৩.৮ শতাংশ। আগের বছর ছিল ১৪.৭। তার আগের বছর ২০১৩ সালে অতি দরিদ্রের হার ছিল ১৫.৫ শতাংশ। এর আগের বছর ছিল ১৬.৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ এখন যে হারে মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ ৩ শতাংশের নিচে অতি দরিদ্রের হার নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়লে দারিদ্র্য কমে ১.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ যদি প্রতিবছর ৮.৮ শতাংশ হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, তাহলে ২০৩০ সালে অতি দরিদ্রের হার ২.৯৬ শতাংশে নেমে আসবে। আশা জাগার মতো তথ্য যে, গেলো দুই যুগে দেশে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৩ কোটি। বিশ্বে যে হারে দারিদ্র্য কমেছে, বাংলাদেশে কমেছে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে। এ তথ্য বিশ্বব্যাংকের। তারপরও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় ৮ নম্বরে বাংলাদেশ। সরকার বলছে, দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরো কমাতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রতি ১০ জনের আটজন অতিদরিদ্র মানুষ নিয়ে যাত্রা শুরু করে মাত্র সাড়ে ৪ দশকে তা নেমে এসেছে আটজনের একজনে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসেবে দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৯০ সালের পর দরিদ্র মানুষের সংখ্যাটা নামিয়ে আনা গেছে অর্ধেকেরও নিচে। এই সময়ে পাশের দেশ ভারত তো বটেই, পুরো বিশ্বের চেয়েই বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে বেশি দ্রুত হারে। শুধু গেল পাঁচ বছরেই দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে ৮০ লাখ। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দরিদ্র মানুষের বাস এখন আফ্রিকার দেশগুলোতে। ১৯৯০ সালেও যা ছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। তারপরেও অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষ ১০ দেশের চারটিই দক্ষিণ এশিয়াতে। যে তালিকায় প্রথম নামই ভারতের। প্রায় ১শ’ কোটি মানুষের দেশটির ২২.৪০ লাখই অতিদরিদ্র। এ হিসেবে আমরা তো পুলকিত হতেই পারি। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, চার দশক পিছিয়ে থাকার পর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়েও ভারতকে পেছনে ফেলবে। ২০১৬ সালসহ আগের তিন বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ডলারের হিসেবে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ আমরা ভারতকে ছাড়িয়ে যাব।
বিদেশি অতিথিদের মুখে কখনো বাংলাদেশের সুনাম শুনিনি। দুর্নামে ভরপুর ছিল বাংলাদেশ। এখন সময় পাল্টে গেছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করাই এখন বাংলাদেশের গুণকীর্তন করছেন। নাক সিট্কানো বিশ্ব ব্যাংকও বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে এশিয়ার বাঘ। বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যেমন, ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, ওএমএস, টেস্ট রিলিফ, কাবিখা ইত্যাদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চহার, গ্রামীণ এলাকায় সড়ক ও জনপথের ব্যাপক উন্নয়ন এবং সংযুক্তি, গ্রামীণ অকৃষি কর্মসংস্থান, প্রবাসী আয় অব্যাহতভাবে বাড়া ও ব্যাপক বিদ্যুতায়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণেই দেশের এই সাফল্য এসেছে। যে করেই হোক এই অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।
বাংলাদেশের সামনে অনেক সম্ভাবনা। নানা সংকট আর সীমাবদ্ধতার মধ্যে, দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পায়ে পায়ে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। আমাদের স্বপ্ন ছিল, এ দেশের মানুষ যাতে অনাহারে কষ্ট না পায়, আমাদের দেশের মানুষ যাতে অশিক্ষিত না থাকে, তার ব্যবস্থা করা। আমরা ধীরে ধীরে সেদিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব।
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক