বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১, মহাকাশ জয়ের পথে বাংলাদেশ

22071

Published on মে 6, 2018
  • Details Image

আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি দেশে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস থাকে যা ঐ দেশের মর্যাদা আর সক্ষমতা এর মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। যেমনঃ সাবওয়ে, সাবমেরিন, বুলেট ট্রেন, নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতৃ মৃত্যুহার, স্বাস্থ্যসেবা, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি। উল্লেখিত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই, বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে এবং অদুর ভবিষ্যতে আরও অনেক অগ্রসর হয়ে উন্নত দেশের কাতারে পৌছে যাবে। বর্তমান সময়ের সব থেকে আনন্দ ও গৌরবের বিষয় যে, বাংলাদেশ খুব শিগ্রই প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ “বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১” উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে। দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ বাংলাদেশের জন্য অতন্ত্য গর্বের একটি বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। এটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় যুক্ত হবে বাংলাদেশ।


১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূউপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধনের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মহাকাশজয়ের সূচনা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দীর্ঘ ৪২ বছর পর লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে কক্ষপথে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের 'ফ্যালকন-৯' রকেট স্যাটেলাইটটি ফ্লোরিডার কেপ কার্নিভাল থেকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করবে। এটি নির্মাণ করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নিয়েছিল। তখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে 'বাংলাদেশের ভূস্থির উপগ্রহ প্রেরণের প্রকল্প' গৃহীত হয় আর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এ প্রকল্প খাতে অর্থ বরাদ্দও রাখা হয়। পুরো বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই এগোচ্ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে 'বঙ্গবন্ধু' নাম থাকার কারণে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। সাবমেরিন অপটিক্যাল ফাইবার কেবল স্থাপনের প্রস্তাব নাকচের মতোই মারাত্মক ওই পশ্চাৎমুখী ওই সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার। ওই পশ্চাৎমুখিন সিদ্ধান্তের জন্যই বাংলাদেশ মহাকাশে অরবিটাল প্লট হারিয়েছে। তাই 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশকে রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য কক্ষপথ বা অরবিটাল প্লট ক্রয় করতে হয়েছে।


মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। আর এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে, যার ২০টি বাংলাদেশ ব্যবহার করবে। বাকি ২০টি অন্যান্য দেশকে ভাড়া দেওয়া হবে। দেশের ৩৭টি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তাছাড়া উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ, দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ স্থাপনের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন- দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওর এবং পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে ব্রডব্যান্ড এর মাধম্যে ইন্টারনেট পৌছানো সম্ভব নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে সেখানে ইনটারনেট পৌছে দেয়া সম্ভব হবে। আর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন করা হলে অর্থনৈতিক লাভও রয়েছে। কিন্তু তার থেকে বড় লাভ হলো দেশের তথ্য নিরাপত্তা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বিদেশি স্যাটালাইটকে আর অর্থ প্রদান করতে হবে না।  মোদ্দাকথা, 'বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১' মহাকাশে স্থাপনের মধ্য দিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ-প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ত্বরান্বিত ও টেকসই হবে।


এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শান্তিকালীন সময়ে নেভিগেশন, জিপিএস, কমিউনিকেশন, যোগাযোগ, ইন্টারনেট সেবা, স্পেস রিসার্চ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস সহ নানাবিধ কাজে ব্যবহারের পাশাপাশি,আমাদের বিপূল পরিমান অর্থ সাশ্রয় করবে। এছাড়া আধুনিক D2H (direct to home) সুবিধা অনেকাংশে সহজলভ্য করবে। যেখানে বিদেশে ফোন করা এবং আমাদের দেশের স্যাটেলাইট টিভিগুলো বিদেশি স্যাটেলাইট এর ট্রান্সপন্ডার মাসিক ভাড়ায় ব্যবহার করে থাকে, তখন আমরা নিজের স্যাটেলাইট এর ট্রান্সপোন্ডার এর মাধ্যমেই এসব স্যাটেলাইট চ্যানেল সম্প্রচার করতে পারব। আপদকালিন সময়ে শত্রুর যুদ্ধ বিমানের আগাম ওয়ার্নিং,দেশের অপটিকাল ফাইবার কমিউনিকেশন বিচ্ছিন্ন হলে তিন বাহিনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, সামরিক বাহিনীর গোপনীয় স্যাটেলাইট ফোন কল, যুদ্ধ জাহাজের গতিবিধি নজরদারি, শত্রু স্থান ম্যাপিং, ড্রোন পরিচালনা সহ নানা কাজেই ব্যবহৃত হবে। আমাদের স্যাটেলাইট দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ থেকে মায়ানমার, ভারত,পাকিস্তান এবং আফ্রিকার কিছু সংখ্যক দেশ পর্যন্ত যাতে কভারেজ করতে পারে তেমন অরবিটাল স্লট ই ব্যবহার করা হয়েছে।পুরো বিশ্ব কভার করতে অন্তত তিনটি স্যাটেলাইট দরকার। আপাতত একটি দিয়ে পথচলা হলেও এটি আমাদের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান-SPARSO, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, আইসিটি ডিভিশন, টেলিকমিউনিকেশন, টেলিমেডিসিন, 4G কানেকশন, E-Commerce এসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখবে।


হয়তো অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের যে কোন অংশে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা রক্ষা এবং দরকারে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিজেদের স্যাটেলাইট দ্বারা শত্রু বাহিনীর গতিবিধি, অবস্থান সম্পর্কে জানতে সক্ষম হবে এমন আশা করাটাও এখন অসম্ভব নয়।

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত