4310
Published on এপ্রিল 26, 2018২৪ এপ্রিল, ২০১৩ বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। এ দিন সাভারে রানা প্লাজায় ঘটে যায় একটি নৃশংস দুর্ঘটনা। যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরান, একটি দুুর্ঘটনায় তাদের জীবনের চাকাগুলো থেমে যায়।
এ দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ে ১ হাজার ১৩৫টি তাজা প্রাণ। অসংখ্য মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলো। স্বজন হারানোর বেদনা, পঙ্গুত্বের আহাজারি, স্বজনের লাশ চিহ্নিত করতে না পারার যন্ত্রণায় আজো কাতরাচ্ছে রানা প্লাজার অসহায় শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলো। রানা প্লাজা দুুর্ঘটনার অনেক দিন পরও ধ্বংসস্ত‚পে মানুষের হাড়, খুলি পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের এইদিনে সকাল পর্যন্ত এই মানুষগুলো মেশিন চালাচ্ছিলেন, উৎপাদন করছিলেন। তাদেরও বেঁচে থাকার স্বপ্ন ছিল। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের গুটিকয়েক মালিকের অতিমুনাফার লোভ এবং অবহেলার কারণেই রানা প্লাজার মতো ঘটনা ঘটেছে, যা এই সেক্টরের কারো কাম্য নয়।
সেদিন শুরু হওয়া ওই উদ্ধারকাজ ২১ দিন পর ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। ধ্বংসস্ত‚প থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল ১ হাজার ১১৭টি। হাসপাতালে মারা যান ১৮ জন। সর্বমোট ১ হাজার ১৩৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ৮৪৪টি মরদেহ শনাক্ত করে মৃতদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং ২৯১টি মরদেহ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে দাফন করা হয়। রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা পোশাকশিল্পকে নিয়ে শুরু হয় দেশি-বিদেশিদের গভীর ষড়যন্ত্র। ধীরে ধীরে সেই ষড়যন্ত্র কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাত। বর্তমান সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা করেছে আর মালিকদের জন্য গ্যাস, বিদ্যুৎ সুলভ করতে সচেষ্ট আছে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে বাঁচানোর জন্য সন্তোষজনক হারে নগদ অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কারণ এখানকার পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং একইসঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পণ্য পরিবহন ভাড়া কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের সরবরাহের ঘাটতি উৎপাদনকে যেন ব্যাহত না করে সেই চেষ্টায় সরবরাহ ঠিক করা হয়েছে। দৈনিক উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও বায়ারদের পক্ষ থেকে আশানুরূপ মূল্য প্রদান না করায় লাভের পরিমাণ বাড়েনি।
তৈরি পোশাকশিল্পকে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্পের বাজারে চীন প্রথম অবস্থানে রয়েছে এবং আমরা দ্বিতীয় স্থানে। চীন তৈরি পোশাকের বিশ^বাজারের প্রায় ৩৬ শতাংশ সরবরাহ করে। বাংলাদেশ মাত্র ৬ শতাংশ সরবরাহ করে। বাংলাদেশের সামনে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য মেশিনারিজ, প্রযুক্তি এসব ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ করতেই হবে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মেশিনারিজ, প্রযুক্তি এসব ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ মানে এই নয় যে, আমাদের দক্ষ শ্রমিকদের কাজ হারাতে হবে। তাদেরও আমাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কোনো ক্রেতাই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে আসে না। বাংলাদেশ মানসম্পন্ন পণ্য দিতে পারে বলেই আসে। বাংলাদেশে এসে অনেকে বিভিন্ন অধিকার নিয়ে, নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু মিয়ানমার, ইথিওপিয়া থেকেও তারা পণ্য কেনে এবং সে সব রাষ্ট্রে এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বায়ারদের নীরব থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সমঝোতা স্মারকে সই করে। ইথিওপিয়াতে শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে শিথিলতা দেখা যায়। কিন্তু তাদের কাছ থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনছেন। এমনকি চীনেও এ সব আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক শিথিলতা রয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন করছেন। আমাদের ব্যবসাকে আমাদেরই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য উদ্যোক্তা, শ্রমিক, সরকার, গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন সহযোগী সবাই মিলে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। ইপিজেডে দেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সুবিধা দিতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিযোগী দেশগুলো উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে যে ধরনের সুবিধা দিচ্ছে আমাদের সে রকম সুবিধা দিতে হবে। বাংলাদেশে রপ্তানিতে আরো বেশি প্রণোদনা দিতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্পের পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্য, ওষুধশিল্প, পাট ইত্যাদি রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারবে।
রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশনের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর দেশের তৈরি পোশাক খাত নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তবে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশের এই পোশাকশিল্প এখন সারা বিশ্বে রোল মডেল। সম্প্রতি ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল সারা বিশ্বে যে দশটি সেরা গ্রিন ফ্যাক্টরি নির্বাচন করেছে তার সাতটিই বাংলাদেশে। বাংলাদেশের আরো ৬৭টি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে উৎপাদনে। আর ২৮০টি কারখানা বর্তমানে ইউজিবিসি কর্তৃক সার্টিফিকেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। রানা প্লাজায় ধস ও তাজরীন ফ্যাশনসের দুর্ঘটনার পর বায়ারদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সসহ বিভিন্ন বায়ারদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বাংলাদেশে গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার উপক্রম আরো অনেক কারখানা।
পোশাকশিল্প শ্রমিকরা বাংলাদেশের উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কমপ্লায়েন্স খাতে বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া না দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই অস্থির হয়ে ওঠে তৈরি পোশাক খাত এবং একশ্রেণির সুবিধাভোগী স্বার্থান্বেষী মহল পোশাক খাতে অস্থিরতা তৈরি করতে চায়। যা এই খাতের সঙ্গে জড়িত মালিক বা শ্রমিক কারো কাম্য নয়।
বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানাই এখন শতভাগ কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করতে সমর্থ। তাজরীন ও রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব ধরনের নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখন নতুন ব্র্যান্ডের নাম।