5883
Published on এপ্রিল 26, 2018যে বিষয়টা এখন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম হিংসা আর সাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রতি লন্ডনে শেখ হাসিনার সফরকে নিয়ে বিএনপির প্রতিবাদের ঘটনায় আমার মতো মানুষেরা হতচকিত ও স্তম্ভিত। প্রতিবাদ তারা করতেই পারেন। করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের বক্তব্য বা কথা বলার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন আচরণ ও কথার সারমর্ম নিয়ে। একদা বিলেতের উপনিবেশ ছিলাম আমরা। বিলেত যাওয়া মানে তখন সভ্য হওয়া। তারা আমাদের থেকে যেমন নিয়েছিল তেমন দিয়েছেও। বাংলা ভাষার উন্মেষ ও প্রসারে তাদের অবদান আছে। আমাদের খাবার থেকে রাজনীতি, পোশাক থেকে সমাজে ইংরেজ শাসনের অনেক অবদান। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও দুনিয়ার সেরা বলেই পরিচিত। গণতন্ত্র বা দেশ শাসনের নিয়মও মানছি তাদের মতো। অথচ তাদের দেশে থাকা বাংলাদেশীদের একাংশ আজ উগ্র ও সাম্প্রদায়িক।
বলতে দ্বিধা নেই, এই প্রবণতা আজ সারা বিশ্বজুড়ে। সিডনিতেও এর প্রভাব দেখতে পাই। এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছি যে আমরা মানুষ আর মানুষ নেই। বাঙালীও আর বাঙালী নেই। হয় সে হিন্দু, নয় মুসলমান। এই বিভেদের জন্য যারা বুক ফুলিয়ে রাজনীতিকে দায়ী করে পার পেয়ে যান বা পেতে চান, তাদের বলি এবার দেখুন এটা কাদের রাজনীতি। কারা মাইক হাতে লন্ডন শহরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম বলার মতো আস্পর্ধা দেখায়! সবচেয়ে মুশকিল তাদের নিয়ে, যারা জানেন কেন এসব বলা হয় বা কেন করা হয়। জেনেও তাদের মুখে রাম নাম হচ্ছে, দুই একজন পাগল কি বলেছে সেটা নিয়ে নাকি মাতা-মাতি করা হচ্ছে। অথচ এটা কোনভাবেই এক বা দুই পাগলের কা- নয়।
শেখ হাসিনা এখন বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত নেত্রী। তাঁকে সম্মানহানি বা অবজ্ঞা করার বিষয়টা অবান্তর। দুঃখজনক হলো, দেশের চাইতে বিদেশের মানুষের কাছে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া নেতাকেও আমরা সম্মান করি না। যারা বলেন তিনি গণতান্ত্রিক আচরণ করছেন না বা সরকারবিরোধী দলকে বলার সুযোগ দেন না, তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কি দেখাল এই ঘটনা? সুযোগ দিলে এরা কি করতে পারে? যারা বিলেতের মতো সভ্য অগ্রসর সমাজে এমন সাম্প্রদায়িক সেøাগান দেয়, তারা দেশে সুযোগ মিললে কি করতে পারে সেটাও বলে দিতে হবে? এদের হাতে পাওয়ার থাকলে এরা দাঙ্গা আর ধর্মীয় উস্কানিতে দেশকে যে রসাতলে নিয়ে যাবে, সেটাই দেখলাম আমরা।
মুশকিলের বিষয় এই, এরপরও একশ্রেণীর মানুষের মনে বিএনপির রাজনীতির জন্য প্রবল মায়া। তারা মনে করে এই দল নাকি মুক্তিযোদ্ধার দল! একজন মানুষের যুদ্ধে যাওয়া আর জড়িত হওয়া এক বিষয় না। সেটা পানির মতো পরিষ্কার হওয়ার পরও যারা দুর্বল তারা ভুলে যায়, লন্ডনে এ দলের ভাবী কা-ারি অপরাধী হয়ে বসবাস করছেন। আর অপরাধীর মন সর্বদাই থাকে কলুষিত। যার অঙ্গুলি হেলনে দেশের রাজধানীর রাজপথে গ্রেনেড হামলা হয় বা মানুষের জান যায় পেট্রোলবোমায় এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও যেখানে গেনেড হামলায় উড়ে যাওয়ার কথা, তাকে কি বিশ্বাস করা যায়? কে না জানে তার ইন্ধন ব্যতীত এমন কিছু হতে পারে না। অথচ আমরা এসব গর্হিত অমানবিক অপরাধমূলক কাজকে গুটিকয় মানুষের কাজ বলে মাফ করে দিতে চাই। কতটা ঘৃণা আর অন্ধত্ব থাকলে এমন কথা মুখ থেকে বের হয়?
বঙ্গবন্ধু এখানে আসবে কেন? তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি এখনও রাজনীতি করেন? না তাঁর কাছে মাথা তুলে দাঁড়াবার হিম্মত আছে এদের? পুত্র দুরে থাক, পিতাই তাঁর সামনে সোজা হয়ে দাড়াতে ভয় পেত। সেই হিমালয় সমান উচ্চতার নেতাকে হেয় করে হিন্দু ধর্মের অবতার বা ভগবানকে টেনে এনে এমন স্লোগানের জন্য এদের বিচার হওয়া উচিত। এরা দেশে তো বটেই, আজ দেশের বাইরেও আমাদের জাতীয় সম্মান, পরিচয় আর ইমেজের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ছে। যা তাদের উগ্র আচরণ ও কাজে স্পষ্ট। তা না হলে তারা একজন উপমন্ত্রীকে এভাবে নাজেহাল করতে পারত না। এই রাগ, ক্রোধ বা হিংসা কেবল বিএনপির একার না, এর সঙ্গে আছে যুদ্ধাপরাধী দলের ইন্ধন। আছে তাদের সহযোগিতা। তরুণ মন্ত্রী যেমন আক্রান্ত, তেমনি ছাড় পাননি বয়সী মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও। বিলেত একদা সভ্যতার সূতিকাগার হলেও তার গায়ে এখন অনেক দাগ। সেই দাগের কিছুটা আমরাও বহন করছি। সেখানে মানুষের জীবনও এখন অনিরাপদ। জঙ্গী হামলার শিকার লন্ডনে এদ্দিন পাকিদের উগ্র বললেও এখন আর আমরাও পিছিয়ে নেই । বার বার এসব হামলার কি কারণ, কারা উস্কানিদাতা বা কারা এর পেছনে সবাই জানেন। বিলেতে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ অবারিত থাকায় নওয়াজ শরীফের পরিবার যেমন সেখানে আছে, তেমনি থাকে আমাদের বিতাড়িত রাজনৈতিক নেতারাও। আছে যুদ্ধাপরাধী, বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্য নায়করাও। ফলে কে কি করছে বা কেন করছে, সেটা বোঝা কঠিন কিছু না। যখন খবরে দেখি, শেখ হাসিনা একের পর এক পুরস্কারে দেশ ও জাতির সম্মান বাড়িয়ে তুলছেন, তখন এই ধরনের আক্রোশ দুঃখজনক হলেও এড়ানো যাচ্ছে না। ব্রিটিশ জরিপে তিনি দুনিয়ার এক শ’ পাওয়ারফুল মানব-মানবীর একজন হওয়ার পরও তাঁর আগমনে নিরাপত্তার জন্য উৎকণ্ঠা আর চিন্তা থাকে বৈকি। যদিও শত্রুরা তাঁর টিকিও স্পর্শ করতে পারেনি।
তারপরও বিচলিত হওয়ার কারণ আছে। সিডনিতেও বিএনপি সমর্থক বা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কমতি নেই। সবচেয়ে ভয়ের তারা যারা উভয়পন্থী মানে মাঝখানে। এরা মুখে যাই বলুক ভোটের বাক্সে ধানের শীষ আর ভেতরে জামায়াত। আমি দেখেছি এদের হিংসা আর ক্রোধের কারণ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি। সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকা ও ভারত। ভারত চিরকালই দুশমন। হাল আমলে মধ্যপ্রাচ্য-ট্রাম্প মিলেমিশে আরেক বাস্তবতা। তাদের ধারণা, এই ধারাকে দেশে বজায় রাখছে আওয়ামী লীগ। নিজেরা নেংটি ইঁদুরের মতো শ্বেতাঙ্গদের পা চাটলেও নির্ভীক প্রধানমন্ত্রীকে তারা পছন্দ করে না। এই মধ্যবিত্তদের জ্বালায় সংস্কৃতি, সমাজ এমনকি ধর্মও আজ বিপাকে।
এমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রবাসী শাখাগুলো এক হওয়ার কথা থাকলেও, আসলে তা নেই। তাদের ভেতর হাজার ফেরকা। তাদের টার্গেট রাজনৈতিক দুশমনরা নয়। তারা আমাকে আপনাকে ঠেকাতে ব্যস্ত। কিভাবে তারা মঞ্চে যাবেন, শেখ হাসিনা আসলে নিজের চেহারা দেখাবেন, সে আশায় করতে পারেন না এমন কাজ নেই। সে নিয়ে বারান্তরে বলব। প্রধানমন্ত্রী সিডনি ঘুরে যাবার পর লিখব আওয়ামী কোন্দলে কে কাকে কি বলেছিলেন, আর কে কাকে উস্কে তারুণ্যকে পুঁজি করে নিজের আখের গোছানোর ধান্দায় স্টেজে যাবার পথ তৈরি করেছেন। এখন একটাই কথা, কিভাবে তাঁর সফর নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হতে পারে। এদেশের সরকার, প্রশাসন বা বাহিনী তাদের কর্তব্যে অবহেলা করে না। হেলা করবে না দেশের নিরাপত্তা কর্মীরাও। শুধু আমাদের মানুষজনই আচরণ ও স্বভাব বদলাতে পারে না। সেটাই কেন জানি খচখচ করে বিঁধতে থাকে কাঁটার মতো। দুই একজন ছাড়া বাকিদের আচরণে এটাই স্পষ্ট, দল বা দলের আদর্শ কিংবা নেত্রী যতটা বড়, তার চেয়ে বড় নিজের আসন পোক্ত রাখা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অস্ট্রেলিয়ায় আগমনের গুরুত্ব ব্যাপক। এদেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে তার আলাপ, ব্যবসা, মেধা বিনিময়, লেখাপড়া করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের ভিসাসহ নানা বিষয় রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশীদের সংবর্ধনা সভা প্রয়োজনীয়, তবে তার গুরুত্ব ভিন্ন ধরনের। সেটা নিয়েই চলছে দেন-দরবার। প্রধানমন্ত্রীর আগমন ও সফর ঘিরে সাম্প্রদায়িক শক্তি বা জাতীয়তাবাদীদের আস্ফালনের দিকে নজর দেয়ার সময় কোথায় আমাদের? অথচ বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে , লন্ডন তারই ইঙ্গিত দিল বৈকি।
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ