5913
Published on এপ্রিল 6, 2018আরও একটি সুখবর। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রাথমিক স্বীকৃতি পায় মার্চ মাসে। এবার সেই স্বীকৃতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতেও। ক্রিকেটের পরিভাষায় বলা যায়, অর্থনীতির ৪৭ বছরের ক্যারিয়ারে এখন সেরা সময় পার করছে বাংলাদেশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সাফল্যে বাংলাদেশ বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৭-১৮) প্রাথমিক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের রেকর্ড গড়া প্রবৃদ্ধিকেও অনেকদূর পেছনে ফেলেছে। গত অর্থবছরের (২০১৬-১৭) চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর (৭ দশমিক ১১) অতিক্রম করে। পরপর তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধির অর্জনের নজিরও সাম্প্রতিক বিশ্বে বিরল।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৭৫২ ডলার হবে। গত অর্থবছর চূড়ান্ত হিসাবে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬১০ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে মাথাপিছু আয় বাড়ছে ১৪২ ডলার। বর্তমানে জিডিপির আকার প্রায় ২৭৫ বিলিয়ন ডলার। জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে স্বাধীনতার পর ৩৮ বছর লেগেছে। আর বর্তমান সরকারের নয় বছরে জিডিপিতে যোগ হয়েছে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি, প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের এই হিসাব করেছে। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের তথ্য মতে, জিডিপির আকার অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৩তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০১০ সালে বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল ৫৮তম। বর্তমান সরকারের নয় বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে ১৫ ধাপ। এ পথ পরিক্রমায় ফিনল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, রোমানিয়া, নিউজিল্যান্ড, কাতার, ভিয়েতনাম, পর্তুগাল, গ্রিস ও পেরুর মতো দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
এদিকে প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তিনি বলেন, এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে দেশের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের যার যার অবস্থান থেকে অবদান রাখার কারণে। তাই সকলে মিলে কাজ করে গেলে আমরা ২০৪১ সালে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দনের বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়ার বিষয়টি অবহিত করে একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছাও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা গত ৫ বছরে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি। প্রতি বছর দেশে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের অভাব আছে, সেটা স্বীকার করি। তবে এটা সাময়িক। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ চিত্র পাল্টে যাবে। কারণ বর্তমানে আমাদের ১৪শ’ প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে বড় বড় অবকাঠামো সৃষ্টির প্রকল্প রয়েছে। আর অবকাঠামো হলো শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তি। ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। কাজ শেষ হলে কেবল এসব অঞ্চলে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর এসবই দৃশ্যমান। দেশের রফতানি বাণিজ্য, রেমিটেন্স ও রাজস্ব- প্রবৃদ্ধি সহায়ক এসব খাতেও ইতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কাজেই প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোন সন্দেহ-সংশয় থাকা উচিত নয়। মন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ বাড়লে প্রবৃদ্ধি টেকসই হয়। এতদিন গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে বেসরকারী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা যাচ্ছিল না। বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এলএনজি গ্যাস আমদানির মাধ্যমে আমরা এখন প্রস্তুত। চলতি বছর শেষে বেসরকারী বিনিয়োগে উল্লম্ফন ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যদি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের আশায় বসে থাকেন, তাহলে তারা পিছিয়ে পড়বেন। কারণ বিশ্বজুড়েই অর্থনীতিতে এখন সুবাতাস বইছে। বাংলাদেশে যারা বিনিয়োগ করবেন, তারা দ্রুতই এগিয়ে যাবেন। মন্ত্রী বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে আমাদের বর্তমান অবস্থান ৪৩তম। চলতি বছর আমাদের জিডিপির আকার ২৫ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। তাই আমরা আরও কয়েক ধাপ এগুতে পারব বলে আশা করি। প্রতি বছর আমরা যদি এক ধাপ করে এগোই, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশ অর্থাৎ উন্নত দেশ হতে পারব।
উল্লেখ্য, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাত বছরে সারাবিশ্বে গড়ে জিডিপিতে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ১৭টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর (৭ দশমিক ১১) অতিক্রম করে। এর আগে প্রায় এক দশক দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ ছিল। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশের যে লক্ষ্য, সে পথে ভালভাবেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রাও দারুণভাবে শুরু হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রা তারই বড় প্রমাণ।
স্বাধীনতার পর ২০০৫-০৬ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার। এরপর গত এক দশকে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলারেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলার। এর আগের দুই অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ১ হাজার ১৮৪ ডলার এবং ১ হাজার ৫৪ ডলার। দেশ যে দ্রুত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এটি তারই লক্ষণ। কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখাকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, ২০১৮ নির্বাচনের বছর। অতীতে নির্বাচনী বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সে দিক থেকে চূড়ান্ত হিসেবে একই রকম প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাছাড়া বোরো ফসল এখনও ঘরে উঠেনি। ফলন কেমন হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে কেমন ক্ষতি হবে, ব্যাংকিং খাতের চলমান অস্থিরতার প্রভাবÑ সাময়িক হিসাবে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয় না। প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধিকে অনেকে ‘জবলেস গ্রোথ’ বলছেন। অর্থাৎ আমাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। যদিও জিডিপি আর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি একই রকম হতে হবে- এমন কোন কথা নেই। তবে কর্মসংস্থান না বাড়লে শুধু আয় বাড়িয়ে টেকসই দারিদ্র্র্য বিমোচন সম্ভব হবে না। এজন্য আমাদের এখন প্রবৃদ্ধির ‘কোয়ালিটি’ বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে।
চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিতীয়বারের মতো ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এ বিষয়টিকে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখছেন মোস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশে জিডিপিতে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক আগেই ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের ঘরে পৌঁছেছে। আমরাও সেদিকে এগুচ্ছি। যদিও প্রত্যাশিত বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ কম। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেসরকারী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। উল্লেখ্য, জিডিপিতে এবার মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ২৫ শতাংশ বেসরকারী খাতের, বাকি ৮ দশমিক ২২ শতাংশ সরকারী বিনিয়োগ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জিডিপিতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ ছিল ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ আর সরকারী বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপিতে বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ ছিল ২২ দশমিক ৯৯ ভাগ আর সরকারী বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬৬ ভাগ।
বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ১৫টি উপখাতের প্রবৃদ্ধি হিসাব করে জাতীয় প্রবৃদ্ধি নিরূপণ করা হয়। সাময়িক হিসাবে শিল্প এবং খাতের ওপর ভর করে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। যদিও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হয়েছে। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ (১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ), যা আগের অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। আগের অর্থবছরের ২ দশমিক ৯৭ শতাংশ থেকে কৃষির প্রবৃদ্ধি এবার ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ ধরা হয়েছে। সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেট নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়েও (৭ দশমিক ৪০ শতাংশ) বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে শিল্পখাত। শুধু বড় বা মাঝারি শিল্পই নয়, ছোট আকারের শিল্পেও বেশ ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মূলত রফতানিমুখী শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্প এক্ষেত্রে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আবার গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর সেবা খাতে আমরা ভাল করতে পারেনি। সাময়িক হিসাবে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যাকালীন পরিস্থিতির পরও কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছে। এতে স্বাভাবিক প্রশ্ন দেখা দেয়। অর্থবছর শেষ হতে এখনও তিন মাস বাকি। চূড়ান্ত হিসাবে কী দাঁড়ায় সেটাই বিবেচ্য বিষয় হবে।
সাময়িক হিসাব মতে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ২৭৫ বিলিয়ন ডলার বা ২৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার ছিল ২৫০ বিলিয়ন বা ২৫ হাজার কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরে জিডিপির আকার আর্থিক মূল্যে প্রায় ২৫ বিলিয়ন বা আড়াই হাজার কোটি ডলার বেড়েছে। ২০১৫-১৬ বছরে জিডিপির আকার ছিল ২২১ বিলিয়ন ডলার। বিবিএসের হিসাব মতে গত বছরের তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে। ডলার প্রতি বিনিময় হার এখন ৮১ টাকা ৫৫ পয়সা, আগের অর্থবছরের এটি ছিল ৭৯ টাকা ১২ পয়সা।
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ