4323
Published on মার্চ 16, 2018বঙ্গবন্ধু বরাবরই গরিব-দুঃখী মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার বড় অংশেই ছিল কীভাবে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন করা যায়। পূর্ব-বাংলার কথা উঠলেই তিনি দরিদ্র কৃষক, নিম্নপদস্থ কর্মচারী, শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ছাত্র ও যুবকদের কথা টেনে আনতেন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মঙ্গল চিন্তায় তিনি ছিলেন সর্বক্ষণ নিমগ্ন। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা ও পক্ষপাতিত্বের প্রতিফলন আমরা আরো জোরালোভাবে লক্ষ করি তাঁর ষাটের দশকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শেষে তিনি যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়ে গেছেন তখন তিনি আরো পরিপক্ব। সাধারণ মানুষের কল্যাণের প্রশ্নে আরো আপসহীন। গরিবের দুঃখে আরো গভীরতর দুঃখী। এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবরে দেওয়া নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক ভাষণে। সেই ভাষণে তিনি দুঃখী মানুষের কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিবহনসহ নানা সুযোগ ও সেবার অধিকার বিষয়ে অঙ্গীকার করেন।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত সদস্যরা যাতে এসব কথা ভুলে না যান সে জন্য তিনি শপথ পাঠ করান। সেদিনের সেই শপথবাক্যের কয়েকটি কথা ছিল এরকম : “...সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে যে কোনোরূপ ত্যাগ স্বীকার করত: আপসহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সদা প্রস্তুত থাকিব।” একাত্তরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের জন্য আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের পুঁজিপতিদের শোষণে বাংলার ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের গ্রাস করে ফেলা হয়েছে। পাট ও চা রপ্তানি বাজার নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। লবণ ও পাট শিল্প ধ্বংসের মুখে। তাই এ দেশে আর ২২ পরিবার সৃষ্টি হতে দেওয়া হবে না।
এরও আগের একটু কথা বলি। ১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান গর্জে ওঠেন সাম্যের পক্ষে। সাধারণ মানুষের জন্য। তিনি প্রশ্ন করেন, “গভর্নরকে মাসে ছয় হাজার রুপি বেতন দেবেন আর আমাদের দেশের গরিব মানুষ অনাহারে মারা যাবে এরই নাম কি ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ?” তিনি বলেন, যে দেশে একজন পিয়নের বেতন মাসে পঞ্চাশ রুপি সে দেশে গভর্নরের এই বেতন কিভাবে মেনে নেওয়া যায়? আজীবন তিনি এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যে ছয় দফা উপস্থাপন করেছিলেন তারও কেন্দ্রে ছিল আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিরসনের চিন্তা। দেশ পরিচালনার সময়ও তিনি গরিব মানুষের দুঃখ বঞ্চনা দূর করতে ছিলেন সদা তত্পর (দেখুন: নূরুল ইসলাম; ‘মেকিং অব এ্যা নেশন: বাংলাদেশ’, ইউপিএল, ২০০৩)।
গরিবের দুঃখ এমন করে বুঝতে পারতেন বলেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ উপেক্ষা করে বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে অবিচল ছিলেন। একাত্তরের পয়লা মার্চ প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার পরপরই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি স্পষ্টভাবে তিনি উচ্চারণ করেন। অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ সারা বিশ্বের সামনে প্রমাণ করবে যে, বাঙালিরা আর উত্পীড়িত হতে চায় না, তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চায়”। তাঁর সেই প্রত্যয়ের কাব্যিক প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চ, রেসকোর্সের ভাষণে। রাজনীতির এই অমর কবি ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যত্ বংশধরদের স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে আর মর্যাদার সঙ্গে বাস করার নিশ্চয়তা দিয়ে যেতে চাই।” দীর্ঘ অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্মের অনানুষ্ঠানিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই তিনি ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিপাগল মানুষ আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তদ্দিনে প্রস্তুত হয়ে গেছেন।
বাঙালি জাতির আনুষ্ঠানিক জন্মের পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধীর, স্থির, শান্ত। তৃপ্ত বঙ্গবন্ধু তাই বলতে পেরেছিলেন, “আমার ভূমিকা আমি পালন করেছি। আমার করার মতো আর কিছু বাকি নেই। আমাকে হত্যা করা হলেও কিছু যায় আসে না”। (রবার্ট পেইনের “দি টার্চার্ড অ্যান্ড দি ড্যাম্নড” বই থেকে)। সেকারণেই দীর্ঘ নয় মাস হানাদারদের কারাগারে বন্দি থেকেও সামান্য বিচলিত হননি তিনি। কোনো ভয়ভীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ফাঁসির সকল আয়োজনও তাকে সামান্যতম দ্বিধান্বিত করতে পারেনি। অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছে নিজের স্ত্রী-সন্তানের কাছে না গিয়ে প্রথমেই বিমান বন্দর থেকে সোজা লক্ষ লক্ষ জনতার মাঝে চলে আসেন। কেননা তারাই যে তাঁর আপনজন। রেসকোর্সের বিশাল জনসমাবেশে জনগণের ত্যাগে মুগ্ধ বঙ্গবন্ধু হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা মিশিয়ে উচ্চারণ করেন, “সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায় তাহলে আমাদের এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে।... কর্মচারীদের বলছি, আপনারা ঘুষ খাবেন না। এদেশে আর কোনো দুর্নীতি চলতে দেওয়া হবে না।”
তিনি তাঁর দেওয়া কথা রেখেছিলেন। দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরপরই অক্লান্ত পরিশ্রম করতে শুরু করেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো নির্মাণ, স্কুল কলেজ চালু করা, সংবিধান প্রণয়ন, পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি, বন্দর মাইনমুক্ত করা, প্রশাসন ব্যবস্থা সচল করা, ব্যাংক-বীমা পুনরায় চালু করার মতো অসংখ্য নীতি-নির্ধারণী ও প্রাত্যহিক কাজ তাঁকে একই সঙ্গে করে যেতে হয়েছে। বাইরের সঙ্গে তাঁকে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়েছে। এসবের মধ্যেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিন্তু এক দণ্ডের জন্যও গরিবের দুঃখ ভোলেননি।
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রাক্কালে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, “পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরো এক শক্তিশালী শত্রু। এই শত্রু হলো অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও দুর্নীতি। এ যুদ্ধ সহজ নয়।” শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা শুধু পতাকা অথবা দেশের নতুন নাম বোঝায় না। ... বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্বাধীনতা অর্থহীন হবে যদি জনগণ প্রাণ ধারণের স্বাধীনতা, অভুক্ত না থাকার ও রুজি-রোজগারের স্বাধীনতা এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পদের অংশীদার হওয়ার স্বাধীনতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।” (সন ম্যাকব্রাইড, সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর ৬২ তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণ থেকে, ২০ মার্চ, ১৯৮২, লন্ডন)। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি কৃষক শ্রমিকের পক্ষে কথা বলেছেন। পঁচাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী ময়দানের এক জনসমাবেশে প্রশ্ন করেন, “আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? আমার শ্রমিক দুর্নীতিবাজ?” নিজেই আবার সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “না”। আর তাই তিনি এদের সম্মান করে, ইজ্জত করে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন শিক্ষিতজনদের। কেননা, তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন যে, এই সাধারণ মানুষেরাই দেশটির মালিক।
বঙ্গবন্ধু অসাম্যকে অপছন্দ করতেন, দুর্নীতিকে ঘৃণা করতেন, কতিপয়তন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। আমরা যদি সত্যি সত্যি তাঁকে শ্রদ্ধা করি তাহলে শুধু আনুষ্ঠানিকতা না করে তাঁর মৌল চাওয়াগুলো জাতির অন্তরে গেঁথে দিতে হবে। বিশেষ করে আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁর গরিবহিতৈষী ভাবনা-চিন্তাকে তুলে ধরতে হবে। এই কাজটি যত বেশি করা সম্ভব হবে বঙ্গবন্ধু আরো তত বেশি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবেন। আমাদের বড়ই সৌভাগ্যের বিষয় যে, তাঁরই সুকন্যা এখন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণ ভাবনার আলোকে পরিচালনা করে চলেছেন। তাঁর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি কৌশল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্নলালিত গণমুখী ভাবনার আলোকেই রচিত। চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সে কথা বেশ স্পষ্ট।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক