পাখি ডাকা ছায়াঘেরা আর দশটা সাধারণ গ্রামের মতোই একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। বৃহত্তর ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের একটি গ্রাম। গ্রামের প্রান্তসীমা দিয়ে বয়ে গেছে বাইগার শাখা নদী। একটু এগিয়ে গেলেই মধুমতি নদী। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী-তীরেই গড়ে ওঠে জনবসতি ও সভ্যতা। টুঙ্গিপাড়া যেন ছবি আঁকা একটি গ্রাম। সবুজে ঢাকা অপরূপ সুন্দর। নবান্নের দেশে আশ্বিনে গ্রামে ধান ওঠে মাঠ ভরে। বর্ষায় বিলগুলো ভরে যায় পানিতে। শীতে লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া আর বসন্তে যেন অপরূপ সাজে নতুনভাবে জেগে ওঠে গ্রাম। এই রকমই একটি নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় এক বাসন্তী সন্ধ্যায় আজানের ধ্বনির মাধ্যমে গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হলো এক নবজাতকের পৃথিবীতে আগমন বার্তা।
১৯২০ সাল, ১৭ মার্চ রাত ৮ ঘটিকা, (৩ চৈত্র ১৩২৭ বাংলা)। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সাহেরা বেগমের ঘর আলোকিত করে যে শিশুটি জন্ম নিল তার নাম শেখ মুজিব। সেদিন কি টুঙ্গিপাড়াবাসী ভাবতে পেরেছিলেন, ‘এই শিশুটিই পরিণত বয়সে হবেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা, বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। বীরপ্রসবিনী টুঙ্গীপাড়া, রতœগর্ভা তুমি, প্রণমী তোমায়। মুজিবের মা-বাবা দুজনই সাধারণ বাঙালি। বাবা-মা বড় ছেলে মুজিবকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। মুজিব ছিলেন ছিপছিপে লম্বা। গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা, তাঁর শিশুকাল কেটেছে টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। ছোটকাল থেকেই তিনি ছিলেন খুব সাহসী ও দৃঢ়চেতা। রূপসী বাংলার যে গ্রাম সারা জীবন তাঁকে আলোড়িত করেছে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন শৈশবেই।
গ্রাম বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দেখে তিনি বেড়ে উঠেছেন। গ্রামের মানুষের সুখ-দুুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-উৎসব, ছিল তাঁর চিরচেনা। মানুষ ও মাটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আশৈশব। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, গরিব কৃষকের ওপর জমিদারের শোষণ তাঁকে আহত করতো শৈশবেই। পারিবারিক পরিবেশের মধ্যেই তিনি শিখে ফেলেছিলেন- অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়। সত্যের জয় সর্বদা। পারিবারিক মুক্ত আবহে তিনি বড় হয়ে উঠতে থাকেন। মুজিব নিরামিষ খেতে পছন্দ করতেন। বেত ফল, ডুমুর আর কলা খুব পছন্দ করতেন। কই, মাগুর, আর শিং মাছ ছিল তাঁর প্রিয়। তবে খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে খেলাধুলা নিয়েই মেতে থাকতেন বেশি। শৈশবে শেখ মুজিব টুঙ্গিপাড়ার গীমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। গীমাডাঙ্গা বিদ্যালয়ে তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। ১৯৩২ সালে বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছেলেকে মাদারীপুরে ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। বাবার-চাকরির বদলির কারণে গোপলগঞ্জে খ্রিস্টানদের পরিচালিত মিশন স্কুলে ১৯৩৭ সালে মুজিব ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। শেখ মুজিব ছিলেন উদার, জেদি এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। তাই মিশন স্কুলের হেডস্যার গিরিশ বাবু মুজিবকে খুব পছন্দ করতেন। ১৯৩৯ সালে মুজিব অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম সাক্ষাতেই দুইজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিভার পরিচয় পান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে আপন করে নেন এবং ভবিষৎ বাংলার অবিসংবাদী নেতা হিসেবে গড়ে তোলেন। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ম্যাট্রিক পাস করেন। তখন তাঁর বয়স ২২ বছর। অসুস্থতার জন্য মাঝখানে তাঁর ৩ বছর পড়া লেখা বন্ধ ছিল। ১৯৪২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি সেখান থেকে বিএ পাস করেন। ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময়ই তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। এ সময় তিনি সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষায় দীক্ষিত হন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আন্তজীবনীতে লিখেছেন ‘ছাত্রাবস্থায় ঢাকার আজাদ পত্রিকার সব বক্তব্য সমর্থন করে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মুসলিম লীগের পক্ষ হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি’।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামে একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবল ধর্মীয় বন্ধন ছাড়া হাজার মাইলের ভৌগোলিক ব্যবধানে দুঅংশের জনগণের মধ্যে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ কোনো কিছুর মিল ছিল না। ১৯৪৭ সালে ইসলামিয়া কলেজের পাঠ চুকিয়ে বাবার ইচ্ছানুসারে শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে অযৌক্তিকভাবে জরিমানা করে। তিনি অন্যায় আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিরদিনের জন্য বহিষ্কৃত হন। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো ঠিকই। কিন্তু অসাম্য, শোষণ, ভিনদেশি শাসনের শৃঙ্খল রয়ে গেল পূর্বের মতোই। পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে বঞ্চিত করার জন্য অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাই তারা প্রথম আঘাত হানে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার ওপর। শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝতে পারলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে কোনোদিনই বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে এক নবদিগন্তের সূচনা হলো। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ মুজিব অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে শেখ মুজিব বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফার জবাব দেবেন বলে হুঙ্কার ছাড়েন। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩৯ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়। আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমদ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। দু’অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা ইয়াহিয়া খানের ওপর অর্পণ করে পাকিস্তানের রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেন। ১৯৭০ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অধীনে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু ইহাহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কারণে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণে দেশবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদীপ্ত করে তোলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :
এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপানাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। জয় বাংলা।
দুই.
স্কুল জীবনেই শেখ মুজিব ১৯৩৯ সালে ১৯ বছর বয়সে চাচা শেখ জহিরুল হকের মেয়ে চাচাতো বোন ফজিলাতুননেসা (রেনুকে) বিয়ে করেন। সামান্য লেখাপড়া জানা সাধারণ বাঙালি মহিলা হয়েও বেগম মুজিব ছিলেন অসাধারণ ধৈর্র্যশীল। সারা জীবন তিনি ছায়ার মতো শেখ মুজিবের পেছনে থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। শত বিপদে ও ভেঙে পড়েননি। শেখ মুজিব যে সফল রাজনীতিবিদ হতে পেরেছিলেন সে জন্য বেগম মুজিবের রয়েছে বিশাল অবদান।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহান ব্যক্তির ইতিহাস লেখা হয় কিন্তু অনেক মহীয়সী রমণীর ইতিহাস লেখা হয় না। তাঁদের স্বামীর কর্মকাণ্ডে খুঁজে পাওয়া যায়। আমার মৃণালিনী দেবীও ছিল তেমনটি’। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীকে যে সাহায্য ও প্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর পত্নী কস্তুরাবাই গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে তাঁর স্বরাজ সাধনায় জীবন সঙ্গিনী বাসন্তী দেবীর যে ভূমিকা, স্বাধীন বাঙালি জাতির অভ্যুদয় ও তার নেশন স্টেট প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বেগম মুজিবের নেপথ্য ভূমিকা তার চাইতে কিছু মাত্র কম নয়, কেবল এখন পর্যন্ত সেই ইতিহাস উদ্ঘাটিত ও স্বীকৃত হয়নি।
তিন.
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ১৯৭২ সালের দশ জানুয়ারি তিনি স্বদেশে ফিরে এসে দেশ পুনর্গঠন কাজে হাত দেন। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত কিছু আত্মস্বীকৃত খুনি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে কিছু সংখ্যক ভিলেনের আগমন ঘটে। এদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এরা পাকিস্তানের অলিখিত প্রতিনিধি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দলমত নির্বিশেষে সবাই জাতির জনকের সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিলেনরা জাতির জনককে শ্রদ্ধা করে না। বঙ্গবন্ধুকে বাক্যবাণে প্রতিনিয়ত অশ্রদ্ধা করে থাকে। তবে এসব ভিলেনরা একদিন রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এটা চরম সত্য। বঙ্গবন্ধু মধ্যগগনের জ্বলন্ত সূূর্যের মতোই এ দেশবাসীর হৃদয়ে উজ্জ্বল থাকবেন। বিশ্ববরেণ্য নেতারাও বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধা করেন। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি’। জাতির জনকের জন্মদিনে রইল তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।