3722
Published on মার্চ 5, 2018বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ উদ্ভাবনের জন্য ধন্যবাদার্হ। এ পর্যন্ত দেশে শতাধিক ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বাংলাদেশ আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ জাতগুলোর উদ্ভাবক। তাতে ধান উৎপাদনে বিপুল উন্নতি হয়েছে এদেশে। স্বাধীনতার পর দেশে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ছিল ১ মেট্রিক টন চাল। এখন তা ৩ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। দেশে এখন খাদ্যাভাব নেই। আমাদের মোট উৎপাদন বছরে কমবেশি সাড়ে ৩ কোটি মেট্রিক টন চাল। দেশে চালের চাহিদা এর বেশি নয়। দীর্ঘকাল ধরে চালের বাজারে ছিল মন্দাভাব। এখন বেশ চাঙ্গা। তাতে উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছে কৃষক। অনুমান করা হচ্ছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার খাদ্যশস্যের উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হবে বাংলাদেশ। স্থিতিশীল হবে চালের বাজার।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য চালের প্রয়োজন কত লাখ মেট্রিক টন? এ নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের হিসেব অনুসারে মাথাপিছু ১৫২ কেজি চালের প্রয়োজনীয়তা ধরে নিয়ে আমাদের বার্ষিক খাদ্য চাহিদা নিরূপণ করা যায়। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬৪ লাখ। তাতে বার্ষিক খাদ্য চাহিদা দাঁড়ায় ২ কোটি ৫৩ লাখ মেট্রিক টন। এর সঙ্গে মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ বীজ, অপচয় ও পশুপাখির খাদ্য হিসেবে ধরে নিলে ২০১৭-১৮ সালে আমাদের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়ায় ২ কোটি ৯১ লাখ মেট্রিক টন চাল। তবে এটা রক্ষণশীল হিসেবে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ এর চেয়ে বেশি চাল ভোগ করে থাকে। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ফল ও শর্করা জাতীয় খাদ্যের অপ্রতুলতা হেতু তারা মোট ক্যালরির প্রয়োজন মেটায় চাল দিয়ে। যেহেতু তাদের নিত্যদিনের চালের চাহিদা বেশি। তাই মাথাপিছু দৈনিক গড়ে আধা কেজি চাল ধরে নিয়ে খাদ্য চাহিদা নিরূপণ করা অধিকতর যুক্তিসংগত। সে মোতাবেক বার্ষিক জনপ্রতি ১৮২.৫ কেজি হিসেবে চাল ধরে নিয়ে আমাদের মোট চাহিদা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪ লাখ টন চাল। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ বীজ, অপচয় ও পশু-পাখির খাদ্য যোগ করে আমাদের মোট খাদ্য চাহিদা দাঁড়ায় বার্ষিক ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চাল। এ পরিমাণ চাল আমরা উৎপাদন করতে সক্ষম। ভালো আবহাওয়ায় বার্ষিক চাল উৎপাদন হবে এরচেয়ে অনেক বেশি। এর পরও আমরা আমদানি করছি চাল। কোনো বছর রপ্তানিও করছি। উদাহরণ স্বরূপ দু’বছর আগে এদেশ থেকে রপ্তানি করা হয়েছে ৫০ হাজার টন চাল। আমদানি করা হয়নি। গত বছর আবার আমদানি করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ চাল। এর কারণ ছিল হাওরের আগাম বন্যা এবং উত্তরাঞ্চলে বন্যা। তাতে উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। ফলে ২০১৭ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে চালের আমদানি হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ টন। এরপরও ২০১৮ সালের শুরুতে আরো আমদানি করা হয়েছে বিদেশি চাল। এক পর্যায়ে মোটা চালের দাম প্রতিকেজি ৬০ টাকা অতিক্রম করে গিয়েছিল। এখন তা ৪০/৪২ টাকায় নেমে এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, চালের দাম প্রতিকেজি কত টাকা হওয়া উচিত। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে চালের উৎপাদন খরচ জানা দরকার। সরকারি হিসেবে গত আমন মৌসুমে প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৭ টাকা। এর সঙ্গে ২০ শতাংশ লাভ যোগ করা হলে চালের খামার প্রান্তে মূল্য দাঁড়ায় ৪৪ টাকা এবং ১০ শতাংশ লাভে তা হয় ৪১ টাকা। বোরো ধানের উৎপাদন খরচ বেশি। সেক্ষেত্রে খামার প্রান্তে বোরো চালের মূল্য দাঁড়াবে ন্যূনপক্ষে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। বর্তমানে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ ১৪ লাখ ২০ হাজার টন। এর মধ্যে ১০ লাখ ১৪ হাজার টন চাল এবং বাকিটা গম। ২০১৬ সালে সমাপনী মজুদ ছিল ৯ লাখ ৫৩ হাজার টন। ২০১৭ সালে ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার টন। তন্মধ্যে চালের মজুদ সবচেয়ে কম ছিল ২০১৭ সালের ৩০ জুন, ১ লাখ ৫০ হাজার টন। সে তুলনায় এবার মজুদের পরিমাণ সন্তোষজনক। এবার মৌসুম শুরুতে আমন চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ মেট্রিক টন। পরে তা বাড়ানো হয় ৬ লাখ টনে। ইতোমধ্যেই ৫ লাখ ৪০ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিটাও অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করা যাবে বলে আশা করা যায়। আগামী বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও এমনই নির্ধারণ করা উচিত। প্রতিবছর সাধারণত ধান ও চাল মিলে ১১ লাখ টন সমমানের চাল সংগ্রহ করা হয়। এবার তা ১৫ থেকে ২০ লাখ টনে নির্ধারণ করা হবে যুক্তিযুক্ত। তাতে অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা থাকবে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রয়োজন হবে না।
চালের বাজার যখন ভালো থাকে তখন কৃষকগণ উৎপাদনে আগ্রহী থাকে সত্য, কিন্তু নিম্ন আয়ের ভোক্তাগণ তাতে নিরুত্সাহিত হয়। তাদের খাদ্য খরচ বাড়ে, কষ্টও বাড়ে। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় আয় দ্রুত বেড়ে গেলেও অতিদরিদ্র শতকরা ৫ ভাগ নিম্নআয়ের মানুষের আয় হ্রাস পাচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রা হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতর। এদের জন্য আলাদা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। এ কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ হতদরিদ্র মানুষকে ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি চাল প্রতিমাসে সরবরাহ করা হচ্ছে। তাছাড়া খোলা বাজারে নির্ধারিত মূল্যে চাল ও আটা বিক্রির স্বাভাবিক কর্মসূচি চালু রাখা হলে নিম্নআয়ের ভোক্তাদের কোনো অসুবিধা হবে না। বাজারে চালের ন্যায়সঙ্গত মূল্য উৎপাদনকে উত্সাহিত করে। এর প্রমাণ মিলেছে গত আমন মৌসুমে। এবার আমনের চাষাধীন এলাকা ও উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। চালের উত্সাহজনক মূল্য কৃষকদের ধানচাষে আগ্রহী করে তুলেছে। ইতিপূর্বে ধানের মূল্য কম থাকায় কৃষক বোরো ধানের চাষ ক্রমেই হ্রাস করছিল। এবার তা বাড়িয়েছে চালের মূল্য বাড়ার কারণে। আশা করা যায়, বোরো ধান কাটার পর কৃষকের বাজারজাত উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পাবে। চালের সরবরাহ বাড়বে বাজারে। তাতে মূল্য স্থিতিশীল হবে। বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।
আমাদের রপ্তানি ও রেমিটেন্স কম হওয়ায় এবং আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের দাম বাড়ছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ চালের অতিরিক্ত আমদানি। ফলে বাজারে চালসহ অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এর লাগাম টেনে ধরতে হলে চাল আমদানি হ্রাস করতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহ বাড়াতে হবে। বর্তমানে আমাদের চালের মোট উৎপাদন কমবেশি ৩৫০ লাখ টন। এর দশ শতাংশ অর্থাত্ ৩৫ লাখ টন অনায়াসেই আমরা সংগ্রহ করতে পারি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে। ন্যূনপক্ষে ২৫ লাখ টন সংগ্রহ করা খুবই দরকার। নতুবা বাজার স্থিতিশীলতার জন্য নিজস্ব সংগ্রহ থেকে কার্যকর হস্তক্ষেপ সম্ভব হবে না।
পুষ্টির দিক বিবেচনায় আমাদের অন্যতম প্রধান খাদ্য হচ্ছে মাছ ও মাংস। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ এ দুটো খাদ্যে ঘাটতিতে ছিল। এখন সে ঘাটতি আর নেই। সাম্প্রতিক এক হিসেব থেকে দেখা যায়, আমাদের জনপ্রতি মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। জাতীয় খাদ্যগ্রহণ নির্দেশিকা ২০১৫ অনুযায়ী আমাদের প্রয়োজন ৬০ গ্রাম মাছ প্রতিদিন ভোগ করা। তাতে দেখা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় আমরা প্রতি দিন গড়ে জনপ্রতি ২.৫৮ গ্রাম বেশি মাছ ভোগ করছি। মত্স্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালে মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫০ হাজার টন। ওই অর্থ বছরে মোট উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ। অর্থাত্ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাছের উৎপাদন হয়েছে ৮৪ হাজার মেট্রিক টন বেশি। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মত্স্যচাষের সাফল্যই আমাদেরকে মত্স্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর করে তুলেছে। আমাদের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর জন্য জনপ্রতি প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। এ চাহিদা পূরণের জন্য বার্ষিক মাংস উৎপাদন ৭১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন হওয়া উচিত। তার বিপরীতে ২০১৬-১৭ সালে মাংসের উৎপাদন হয়েছে ৭১ লাখ ৫৪ হাজার টন। ফলে জনপ্রতি চাহিদা অনুযায়ী মাংস উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম ও বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক পোল্ট্রির উৎপাদন সম্প্রসারণের ফলে মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশের এ সাফল্য এসেছে। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খাদ্য উৎপাদনে উপযুক্ত পণ্যমূল্য বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। তাতে কৃষকের আগ্রহ বাড়ে। উৎপাদন উত্সাহিত হয়। তাই টেকসই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষি উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা দরকার। তাতে খাদ্য উৎপাদনে নিরন্তর স্বয়ম্ভর থাকা সম্ভব হবে।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল, ভিলেজ (ইউজিভি)
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক