নীরব জবাবে জ্বলে ওঠা বাংলাদেশ ও আজকের বিএনপিঃ অজয় দাশগুপ্ত

8910

Published on ফেব্রুয়ারি 28, 2018
  • Details Image

ছবিতে দেখলাম বিএনপির মহাসচিব একলা বসে আছেন। একুশের সকালে মন খারাপ করে ফুটপাথে বসে থাকা মির্জা ফখরুলকে দেখে মনে হলো হায়রে নিয়তি। বিএনপি তার মহাসচিবদের প্রতি কখনো সুবিচার করেনি। সালাম তালুকদারের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের। তখন কী রমরমা তাদের! গদিতে এসে দুঃসময়ের মহাসচিব সালাম তালুকদারকে বিদায় দিলেন খালেদা জিয়া। বেচারা তালুকদার এক সময় হারিয়ে গেলেন এবং বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। একই পরিণতি দেখেছি মান্নান ভুঁইয়ার বেলায়। মান্নান ভুঁইয়া বাম দল মানে ভাসানী ন্যাপের নেতা ছিলেন। স্বভাবতই মুসলিম লীগ ও নব্য বিএনপি নেতাদের চাইতে আলাদা। রাজপথে থাকা বিএনপিকে বেগবান করা এই তিনিও পড়লেন ছিটকে। ওয়ান-ইলেভেনের পর তাকে চরম অপমানের সঙ্গে বিদায় দিয়েছিল বিএনপি। এরপর খন্দকার দেলোয়ার। ভদ্রলোক এখন মরহুম। কিন্তু বলতে হবে একমাত্র তারই একটি ভিডিও ছিল যেখানে কথা বলতে বলতে পাতলুন খুলে যাওয়ার দৃশ্যও ছিল। জানি না কতটা বানোয়াট আর কতটা সত্য। তবে সেই পাতলুন খোলার শুরু। মুশকিল হলো- মহাসচিবদের এই অপমান আর বেদনার পরও আমাদের সুশীলদের চোখে পড়ল আওয়ামী লীগে কোণঠাসা হয়ে পড়া সচিব আবদুল জলিলকে। এক রাজাকার-ঘেঁষা লেখক যিনি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে চাঁদা তুলে চলেন, উপন্যাস লিখে ফেললেন- ‘আবদুল জলিল যেভাবে মারা গেলেন’। কেন বাবা? খন্দকার সাহেবের কীভাবে পাতলুন খুলল বা সালাম তালুকদার কীভাবে একা হলেন সেটা লিখলেন না কেন? আজ যখন মির্জা সাহেব পথে একা বসে তখন আপনারা কী লিখবেন এ নিয়ে? লিখবেন না।

খালেদা জিয়ার এটাই দুর্ভাগ্য। তার দলে সুবিধাবাদী আর সুযোগ সন্ধানীদের ভিড়। কারণ বিএনপি মূলত একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। দল হওয়ার পথে পা বাড়ালেও পারেনি। যেখানে বাম দল ভাঙতে ভাঙতে ছোট হওয়ার পরও ঢাকার রাজপথ লাল পতাকায় লাল করে দিতে পারে, যেখানে এখনো অনেক ইস্যুতে সাধারণ মানুষের চাপে সরকার সমঝোতায় বাধ্য হয়, সেখানে বিএনপি আন্দোলন দূরে থাক মাঠেই নামতে পারে না। এই দীনতা দূর হবে লন্ডনের নেতার জোরে? যারা মনে করেন যে আমরা আওয়ামী লীগের হয়ে লিখি তাদের বলি, সত্য বললে যদি তা কোনো দল বা মতের দিকে ঝুঁকে পড়ে আমাদের কী করার আছে? আসলে সত্য এমনই। সে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। একটা সময় ছিল যখন খালেদা জিয়া জেলে যাওয়া দূরে থাক ওই রাস্তায় হাঁটবেন এটাও ভাবা যেত না। অথচ আজ এটাই সত্য।

বিএনপি এখনো টিকে আছে মিডিয়ার জোরে। তার একটা শক্ত অবস্থান মানুষের মনে থাকলেও সাংগঠনিক ভিত্তি বড় দুর্বল। যার মূল কারণ তাদের আদর্শগত সমস্যা। আমি তাদের অনেক নেতাকে চিনি যাদের ব্যবহার এবং সৌজন্যবোধ আওয়ামী নেতাদের চাইতে অনেক ভালো। এরা ভদ্রলোক। কিন্তু এরা দলে ভালো জায়গায় থাকতে পারেননি। সামনের সারিতে চলে আসা বাবর, গিয়াস উদ্দীন এদের দেখলেই বোঝা যাবে কোথায় চলে গিয়েছিল নেতৃত্ব। সে পাপের ফল পাচ্ছে তারা আজ। পরিচয় সংকট বিএনপিকে কতটা দুর্বল করেছিল এখন তা তারা বুঝলেও ফেরার পথ নেই। দূর প্রবাসেও আমরা এদের নাম ভাঙানো এজেন্টদের চিনি। ওপরে মুখে বড় কথা বললেও মূলত অন্তরে জামায়াত। মজার ব্যাপার এই তাদের টার্গেট আওয়ামী নেতারা নন। তাদের টার্গেট আমাদের মতো লেখকরা। যারা গান করেন, কবিতা লেখেন কিংবা শিল্পচর্চা করেন, তাদের পেছনে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা নেড়ি কুকুরকে দেখলেই বুঝি বিএনপি মার্কা বুদ্ধিজীবীর দৌড় কতটুকু। এরাই সর্বনাশের মূল কারণ। একবার আইনের আওতায় আনলে এরা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। যে তালিকায় এখন বিদেশের অনেকেই আছে।

বলছিলাম ফখরুল সাহেবের কথা। এই ভদ্রলোক বলেন ভালো। আচরণও মন্দ না। কিন্তু তার রাজনীতি মানুষ কেন নেবে? শুধু সহমর্মিতার জন্য কেউ রাজনীতিতে যায় না। সেখানে ঘাত-প্রতিঘাত আর বিবাদের ভেতরই দল বড় হয়। নেতারা হয়ে ওঠে মানুষের চোখের মণি। ফখরুল সাহেব একবার চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন তিনি আর রাজনীতিতে থাকতে চান না। সিঙ্গাপুর চলে যাওয়া তার দুচোখের পানিতে মানুষ ব্যথিত হওয়ার পরিবর্তে জানতে চেয়েছিল, যে মেয়েটি তাদের আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যের কারণে একচোখ হারিয়েছিল সে কীভাবে দুচোখে কাঁদবে? এই বিষয়টাই মাথায় নেই তাদের। তারা ভাবে সস্তা জনপ্রিয়তা পাকিস্তানপ্রীতি দিয়েই পথ পার হয়ে যাবে। মনে আছে একবার মুন্নী সাহা খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করেছিলেন- একশর ওপর মানুষের জান নিয়ে বিএনপি কী পেল? চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বেগম জিয়া দম্ভভরে উত্তর দিয়েছিলেন জনগণের সমর্থন। এখন হয়তো সেই শতাধিক লাশের গোপন জিজ্ঞাসা ঘুরছে কারাগারের দেয়ালে, কোথায় সেই গণসমর্থন?

খালেদা জিয়া আইনের আওতায় জামিন পাবেন, না মুক্তি পাবেন, না ছাড়া পাবেন- সেটা আমাদের বিচার্য না। কিন্তু বলব ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের অস্তিত্ব আর শিল্প-সাহিত্য মনন নিয়ে খেলা বন্ধ করুন। কোনো কারণে গদি ফিরে ফেলে যদি প্রতিশোধের রাজনীতিতে ফেরেন তবে তো আর কোনোকালে আপনাদের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনে পড়ছে জেলে যাওয়ার কদিন আগে খালেদা জিয়া বলতে শুরু করেছিলেন তারা সরকারে এলে আর কোনোদিন প্রতিশোধের রাজনীতি করবেন না। কিন্তু সেটা যে কথার কথা, মনের কথা না সেটা মানুষ বোঝে। কারণ তাদের দাবার ঘুঁটি চলে লন্ডন থেকে। যেখানে উসকানি ছাড়া আর কিছু নেই। মনে পড়ছে আওয়ামী লীগের কথাও। তাদের যখন দুঃসময় নির্বাচনে জিতে আসাটা প্রশ্নবোধক বি চৌধুরী দম্ভ করে টিভিতে বলেছিলেন আগামী ৫০ বছরেও নাকি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবে না। মানুষ সে বক্তব্য ভালোভাবে নেয়নি। নিয়েছিল ঢাকার প্রয়াত মেয়র হানিফ সাহেবের কথা। তিনি ঢাকার এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে অতীতের সব দোষত্রুটির জন্য মার্জনা চাওয়ার পর মানুষ ভোট ঢেলে দিয়েছিল নৌকার বাক্সে। মানুষ এমনই। তারা শান্তিপ্রিয়। তাদের কামনা মঙ্গল আর শান্তি।

খালেদা জিয়া জেলে। মওদুদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বাকিরা এই আছে এই নেই। আর মির্জা ফখরুল মাটিতে একা বসে দিন গুনছেন। এই কি বিএনপির শেষ যাত্রা? সময় এর উত্তরদাতা। তবে মানতে হবে বাংলাদেশের রাজনীতি কারো দম্ভ বা গর্ব মানেনি। তার মাটিতে রক্ত, আকাশে রক্তিম সূর্য, নদীতে মায়ের মুখ, ফুলে শহীদের ভালোবাসা- এ দেশকে ভালো না বাসলে সে গোপনে এমন প্রতিশোধ নেয় যা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যদিনের রক্তমাখা কেক, নিহত লাখো মানুষের সংখ্যার সঙ্গে প্রতারণা, দেশকে তুচ্ছ করা, ইতিহাসকে পায়ে ঠেলার যে পাপ সে পাপই আজ মির্জা ফখরুল ও তার দল বিএনপিকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। এখান থেকে সরকারি দলকেও শিখতে হবে। এক মাঘে শীত যায় না কারোই। রাজনীতি সেটা মানলেও রাজনীতিবিদরা সেটা বোঝেন না। যখন বোঝেন তখন হয় জেলে নয়তো পদহীন। নয়তো তখন অনেক দেরি। বাংলাদেশ এ ভাষাতেই জবাব দেয়।

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত