4941
Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2018
মাতৃভাষা সব দেশে, সব মানুষের জীবনে বিরাট গর্বের বিষয়। এর একটিই কারণ, তা হলো এই মাতৃভাষার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের আস্থা, আমাদের স্বপ্ন ও আমাদের ঐতিহ্য ধারণ করে থাকি এবং এই চিন্তাবোধ থেকেই সেই ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রাণের মানুষ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বাংলা ভাষার কথা তুলে ধরেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল অতি সামান্য—বাংলার দরিদ্র কৃষক যাতে করে তার শহরে পড়ুয়া সন্তানের সঙ্গে নিজ ভাষায় যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে, মনের কথা বলতে পারে, তাকে মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে পারে। আর এই বিষয়গুলো যেন সে তার নিজের মাতৃভাষা বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে, সেটিই ছিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের মূল বিষয়।
সেদিন পাকিস্তান শাসকশ্রেণি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আহ্বানে কর্ণপাত করেনি, যার ফলে গোটা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। আজ ৭০ বছর পর যখন আমরা দেখি যে সুদূর সিয়েরা লিওনে আমাদের বাংলা ভাষাকে সে দেশের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশপ্রেমও বেড়ে যায় অনেকখানি। সুদূর আফ্রিকার সেই সিয়েরা লিওনে যদি বাংলা ভাষাকে কোনো গুরুত্ব না দেওয়া হতো, তাতে জাতি হিসেবে আমাদের কোনো ক্ষতি হতো কি না কিংবা এই বিষয়টি কি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াত? আমরা আমাদের দেশে বাংলায় কথা বলি, গান শুনি, স্বপ্ন দেখি, এই তো বেশ। এর চেয়ে বেশি আমাদের চাহিদা ছিল কি?
ওপরের প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, মানুষের চাহিদার বাইরে এমন কিছু কথা আছে এবং এমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে, যা আমরা কখনো কল্পনা করতে পারি না। নব্বইয়ের দশকে সিয়েরা লিওন গৃহযুদ্ধে বাঁধা পড়ে যায়। হতাহত অনেক হয় এবং সমস্যা এত তীব্র হয়ে ওঠে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাধ্য হয় পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করতে। দেশটিকে তার নিজ নেতাদের আত্মঘাতী কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন এবং সেই কাজটি সম্পন্ন করতে পারে ওই সব দেশ, শান্তি ও সমৃদ্ধিই যাদের লক্ষ্য। সেই বিবেচনা থেকেই অন্য কয়েকটি দেশসহ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলো তার সৈনিকদের মাধ্যমে সিয়েরা লিওন নামক দেশটিকে রক্ষার জন্য। ওই দেশের নাগরিকদের আশ্বস্ত করা হয় যে তাদের জীবন আবার স্বাভাবিক হবে এবং যে হানাহানি চলছে তার অবসান ঘটবে, হয়েছিলও তাই। আমাদের সেনাবাহিনী, আমাদেরই বাঙালি সৈনিকরা সিয়েরা লিওনকে তার স্থিতিশীলতা ও আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আত্মমর্যাদা যে একটি জাতীয় জীবনে কতটা গুরুত্ব বহন করে, সেই সত্যটি আমরা বাঙালিরা অনুধাবন করেছিলাম সেই ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আমরা করেছি আমাদের জাতিসত্তা রক্ষার্থে। তৎকালীন নবগঠিত সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে এবং তত্ত্বাবধানে মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করেছে, মুজিবনগর সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন আমাদের ভাগ্য নির্ণয় করার দায়িত্ব তাঁর হাতে দিয়েছিল। এ যুদ্ধে তৎকালীন সেনাবাহিনীর বাঙালি বিভাগগুলো এবং বাঙালি সেনা সদস্যরাই প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, তবুও আমরা দমে যাইনি। ১৯৭১ সালের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলাম, আমরা আমাদের আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছি। আমরা স্বাধীনতা এনেছি যুদ্ধ করে। কোনো আলোচনা দ্বারা বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তবে এটাও সত্য, বিশ্বে এমন দেশও আছে, যাদের সেই শক্তি নেই, যা ব্যবহার করে নিজ মর্যাদা রক্ষা করতে পারে অথবা ফিরিয়ে আনতে পারে। উদাহরণ সেই সিয়েরা লিওন। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনীর সদস্য সিয়েরা লিওনে গিয়ে অনেক প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে সেই দেশে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। বাংলাদেশের সৈনিকদের সঙ্গে অন্য দেশের সৈনিকও ছিলেন। তবে বোধ করি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটু বেশি নিজেদের এই শান্তি মিশনে আত্মনিয়োগ করেছিল। ফলাফল আমরা দেখেছি। সেই ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রপতি আহমেদ তেজান কাব্বাহ আমাদের বাংলা ভাষাকে তাঁর নিজের দেশের সরকারি ভাষা বলে গ্রহণ করে নিয়েছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমাদের সৈনিকরা যেমন সম্মানিত হয়েছেন, তেমনি আমাদের দেশটিও মর্যাদায় আরো উঁচু স্থান লাভ করল। এটি একটি বিরল ঘটনা। একটি দেশ অন্য আরেকটি দেশের প্রতি এমনই আকৃষ্ট হবে যে ওই দেশের ভাষাও আপন করে নেবে, এমন উদাহরণ আমাদের সামনে নেই।
আবার আমাদের জীবনে ফেব্রুয়ারি এলে এরই সঙ্গে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৪ সালে ওই পাকিস্তানের লাহোর বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, যে বাহিনী আমাদের এত মানুষ হত্যা করল, সেই সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘আমার সোনার বাংলা’ বাজিয়ে শোনাল, এই স্মৃতিগুলো মনে জেগে ওঠে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলা ভাষণ, এই যে আনন্দ, এই যে আত্মতৃপ্তি তা ভুলে যাওয়ার নয়। আর সেই না ভোলার গাঁথামালায় রয়েছে আমাদের সেনাবাহিনীর অবদান সুদূর সিয়েরা লিওনে। সেই দেশটিকে আমাদের সৈনিকরা সাহসিকতার সঙ্গে ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। ১১ বছর গৃহযুদ্ধে, ১৯৯১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত, কেউ ভাবেনি যে শান্তি ফিরে আসবে এবং কেউ কোনো দিন কল্পনাও করেনি যে বিদেশ থেকে আগত শান্তিরক্ষী বাহিনী এই বিধ্বস্ত দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে নিয়ে আসবে। সেই কঠিন কাজটি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের এই যোগ্য সন্তানরা দেশের ভেতরেও নিজ ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁদের পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
১৯৪৮ সালে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা না বললেই নয়। ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান বাঙালি সেনা সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, বাঙালি সেনা সদস্যরা শুধু উর্দুতে কথা বলতে পারবেন, বাংলায় নয়। সেখানেও উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। আইয়ুব খানের এ বক্তব্যে বাঙালি সেনা অফিসার মেজর হোসেন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান সৈনিকদের পশতু ও উর্দু বলার উদাহরণ দিয়ে বাঙালি সেনাদেরও বাংলা ও উর্দুতে কথা বলার দাবি জানান। পক্ষান্তরে তৎকালীন ক্যাপ্টেন গণি (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা) সোজা ভাষায় জানিয়ে দেন যে তাঁরা উর্দুতে নয়, বাংলায়ই কথা বলবেন। কয়েক দিন পর একটি লিখিত আদেশে বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং সৈনিকদের বাংলায় কথা বলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মেজর হোসেন, ক্যাপ্টেন গণি ও আরো অনেক বাঙালি সেনা সদস্য ওই আদেশ অমান্য করে পেশাগত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। তৎকালীন বাঙালি সেনা সদস্যরাও মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন সোচ্চার।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা আবার সেই গল্পটি বলব আমাদের নতুন প্রজন্মকে। সেই ইতিহাস তুলে ধরব, যে ইতিহাস ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিবাহিনী সৃষ্টি করেছে, যে ইতিহাস রচনা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী আফ্রিকার সিয়েরা লিওন নামক দেশে। আজ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা বলব আবার। কথা বলব তাঁদের নিয়ে, যাঁরা ১৯৫২ সালে মাতৃভাষাকে জীবিত রাখার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। গান গাইব আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে, আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে।
লেখকঃ সৈয়দ বদরুল আহসান
সৌজন্যেঃ কালকের কণ্ঠ