2315
Published on ফেব্রুয়ারি 6, 2018রাজধানীর বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে চলমান একটি দুর্নীতি মামলার আসন্ন রায়ের আগে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভাটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। মিডিয়াও বেশ সরগরম ছিল। চলমান নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন অভিযাত্রায় এই বছরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মাঝে উন্নয়ন অভিযাত্রায় ছন্দপতনের একটি আশঙ্কা রয়েছে। বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ও কর্মসূচির চরিত্র নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা রয়েছে—একথা অনস্বীকার্য।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাইজ বেশ বড়। বড় মিলনায়তন ছাড়া এর সভা করা সম্ভব নয়। এ কারণেই হয়তো তাদের কাউন্সিলের পর এই প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হলো। অথবা বিএনপির নীতি-নির্ধারণে এই কমিটির করণীয় কিছু নেই বলে সভা আহ্বান করা হয় না। দলটি এখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীর দল নয়, প্রভু-ভৃত্যের দলে পরিণত হয়েছে। লন্ডনে বসে তারেক রহমান যা হুকুম করেন, বাংলাদেশে বিএনপি নেতারা তা পালন করেন। এখনও এই দলে যে সব রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন, তারা গা বাঁচিয়ে কোনও রকমে দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। একটি সময় চেয়ারপারসন তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু এখন তার সমসাময়িক সহকর্মীরাও বিএনপিতে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছেন।
ফলে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভাটি অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মতো নীতি-নির্ধারণী সভার চরিত্র ধারণ করতে পারেনি। এটি আর দশটি আলোচনা সভার রূপ নিয়েছে। অনেকাংশে দলের লিবারেল ডেমোক্রেটিক নেতাদের তুলোধুনা ও হুমকি-ধমকি দেওয়াই সভার মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সরকারের সমালোচনা ও সরকার উৎখাতের ঘোষণা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু নিজ দলের নেতাদের সম্পর্কে একই দলের চেয়ারপারসনের পাবলিকলি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ স্বাভাবিক নয়। বাজারে প্রচার আছে, বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের অনেক নেতা বিএনপি ভেঙে নির্বাচনে অংশ নেবে। স্বয়ং চেয়ারপারসনের হুমকি বাজারের এই জল্পনা-কল্পনাকে সত্যের কাছাকাছি নিয়ে গেলো। এতে দলনেত্রী ও দলের দীর্ঘদিনের নেতাদের পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা প্রকাশ্য রূপ পেলো।
বিএনপি নেত্রী একাধিকবার প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে পাবলিক মানি আত্মসাতের মামলা করেছে। পৃথিবীতে রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে হরহামেশা মামলা হয়।
রাজনীতিবিদরা আদালতে বীরের মতো মামলা নিয়ে আইনি লড়াই করে বিজয়ী বা পরাজিত হন। কখনও কখনও রাজনৈতিক মামলা গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে সুরাহা হয়। যেমন এদেশে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সুরাহা হয়েছে গণঅভ্যুত্থানে।
কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চলমান মামলাটি রাজনৈতিক নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়ের করা নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুদকের চেয়ারম্যান থাকার সময় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। বিস্তারিত তদন্ত প্রক্রিয়াও সেই আমলের।
রায়ের অপেক্ষমাণ মামলাটির সত্য-মিথ্যা নিয়ে মন্তব্য করা এই মুহূর্তে সমীচীন নয়। স্বাধীন আদালত বিবেচনাপ্রসূত রায় দেবে। রায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুকূলে গেলে তিনি বিজয়ী হবেন। তার বিপক্ষে গেলে তিনি হাইকোর্টে আপিল করবেন, সেখানে পরাজিত হলে অ্যাপিলেট ডিভিশনে যাবেন। এরপর তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে। বিএনপি নিম্ন আদালতকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে প্রচার করার চেষ্টা করছেন এবং ন্যায় বিচার পাবেন না বলে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করছেন। এমনকি রায় বিপক্ষে গেলে দেশ অচল করার হুমকিও দিচ্ছেন। মূলত এসব করা হচ্ছে আদালত ও আইনের শাসনের প্রতি অনৈতিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। যদি বিএনপির বক্তব্য তর্কের কারণে মেনেও নেই। তাতেও তাদের ভয় কোথায়। উচ্চ আদালতে তাদের প্রাধান্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি সর্বজনবিদিত। সেক্ষেত্রে তাদের শঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ দেখি না। কিন্তু তড়িঘড়ি করে বিএনপির গঠনতন্ত্র পরিবর্তন এবং নির্বাহী কমিটির সভার নামে চেয়ারপারসনের বক্তব্যের মাঝের ভারসাম্যহীন অংশটুকুতে তার নৈতিক পরাজয় হয়েছে। আদালতের রায়ের আগেই তিনি স্বেচ্ছায় পরাজিত হয়েছেন। যেহেতু তিনি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেছেন, সেহেতু আইনের শাসনের প্রতি তার ন্যূনতম সম্মানবোধ থাকতে হবে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টি হলো, তার বক্তৃতায় প্রজাতন্ত্রের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের উসকানি দেওয়া। গণতন্ত্রের জন্য প্রতিনিয়ত মায়াকান্নায় নিমজ্জিত একাধিক চিহ্নিত মিডিয়া তার বক্তৃতার এই অংশটুকু শিরোনাম করে উসকানিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণ তার সঙ্গে আছেন বলে তিনি দাবি করতেই পারেন। তিনি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তার সঙ্গে আছে এমন দাবি কোনও রাজনীতিবিদ করতে পারেন না। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন দায়িত্বহীন বক্তব্য আতঙ্কজনক।
তিনি মূলত, দু’টি কারণে এমন বক্তব্য রেখেছেন। এক. তার দলের হতাশাগ্রস্ত নেতা- কর্মীদের আশ্বস্ত করে মনোবল চাঙ্গা করা। দুই. সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের উসকানি দিয়ে অসাংবিধানিক পন্থায় সরকার উৎখাতে প্ররোচিত করা ও তাদের অনুকম্পা লাভের চেষ্টা করা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এদেশে সব সামরিক ক্যু ও পাল্টা ক্যুর চাক্ষুষ সাক্ষী। দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের রক্তের স্রোত বইতে দেখেছেন। এক ক্যু-তে নিজের স্বামী হারিয়েছেন। অন্য ক্যু-তে নিজের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি অসংখ্য অফিসার ও সৈনিক হত্যা হতে দেখেছেন। প্রহসনের বিচারে অগণিত দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকের ফাঁসি হতে দেখেছেন। এরপরও তার মতো দায়িত্বশীল পদমর্যাদার একজন রাজনীতিবিদ সশস্ত্র বাহিনীকে উসকানি দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই সমীচীন হয়নি।
রাজনীতিবিদকে কেবল তার সততা, পরিশ্রম, কমিটমেন্ট ও জনতার ওপর নির্ভর করা উচিত। কোনোভাবেই সিভিল আমলা বা মিলিটারি শক্তি বা বর্হিশক্তির ওপর নির্ভর করা উচিত নয়। এটি ঠিক যে, মিলিটারি শক্তির অপব্যবহার করে তার প্রয়াত স্বামী ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ছিল একটি সদ্যপ্রসূত রাষ্ট্রের প্রাথমিক ও অস্থির সময়। সেই দিনগুলোয় পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি উৎপাদিত অফিসার ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা অফিসারদের মাঝে চেতনাগত, চরিত্রগত ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিরোধ ও সংঘাত ছিল। জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন।
সেই দিন এখন বিগত। বাংলাদেশের বয়স বেড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা, দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে, পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি শাখার পেশাদারিত্ব আজ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। সমর সামগ্রীর ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। কর্মকর্তা ও সৈনিকরা প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার পথ ধরে আজ পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশ গঠন, টেকসই উন্নয়ন ও যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনী অনবদ্য অবদান রাখছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে মর্যাদার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে এবং বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে জাতীয় অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা যোগ করছে। একদা সামরিক বাহিনীর পেছনে বরাদ্দকে কিছু মানুষ অপচয় বা অতি ব্যয় বলে অভিহিত করতেন। আজ দিন বদলেছে, এখন এদেশে সামরিক খাতে বরাদ্দকে ব্যয় নয় বিনিয়োগ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
আজ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী আমাদের গর্ব। এই সশস্ত্র বাহিনীকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য যেকোনও ধরনের উসকানি দেওয়া কেবল নৈতিকতা বর্জিত নয়, এটি একটি অপরাধ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত হওয়া উচিত।
কোনও রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এ ধরনের বক্তব্য দিলে বা কলাম লিখলে কোনও দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের তা প্রচার বা প্রকাশ করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও প্রেসের পদস্থ বিজ্ঞজনদের চিন্তা করা প্রয়োজন। দেশ আমাদের সবার। দেশে শান্তিরক্ষা ও কল্যাণের দায়িত্বও সবার।
লেখক: সংসদ সদস্য ও সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ