ফিরে দেখা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

7018

Published on জানুয়ারি 23, 2024
  • Details Image

কোনো একটি গণদাবি আদায়ের সব শান্তিপূর্ণ পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন সেই দেশে কোনো এক বা একাধিক  নেতা যদি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের মাধ্যমে সেই দাবি আদায় করতে পারেন, তাহলে সেই আন্দোলনকে গণ-আন্দোলন বলা যেতে পারে। আর যখন সেই আন্দোলন একটি গণবিস্ফোরণের মাধ্যমে সফল হয় তখন তাকে গণ-অভ্যুত্থান বলা হয়। আর যখন শুধু বন্দুকের নলের জোরে একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা হয়, তখন তাকে সাধারণত সামরিক অভ্যুত্থান বলা হয়। গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকে। আর সামরিক অভ্যুত্থানে বন্দুকের সম্পৃক্ততা থাকে। জনগণ সঙ্গে থাকলে অনেক সময় বন্দুকের নলের ক্ষমতাও অসহায় হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিককালে তুরস্ক তার একটি বড় উদাহরণ। উপমহাদেশে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস আছে, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস সম্ভবত একটিই আছে, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, যার সফল পরিসমাপ্তি হয়েছিল পাকিস্তানের লৌহমানব নামে খ্যাত আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে। আর এই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ। সঙ্গে ছিল শ্রমিক-জনতা। এই অভ্যুত্থানে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র-জনতারও সম্পৃক্ততা ছিল। তবে যেহেতু পকিস্তানের পশ্চিম অংশের সাধারণ মানুষ তেমন একটা রাজনীতিসচেতন ছিল না, তাই এ অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকাও তেমন একটা জোরালো ছিল না।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলন মূলত ঢাকায় শুরু হয়েছিল আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হিসেবে। ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। সেই সংবিধানের আলোকে ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে প্রথম সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, বিশেষ করে সামরিক-বেসামরিক আমলা পরিবেষ্টিত সরকার সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতার হাত বদলের ওপর তেমন একটা বিশ্বাস রাখতে পারছিল না। কারণ তারা দেখেছে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে কিভাবে বাঙালিরা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর মুসলিম লীগকে পূর্ব বাংলায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। নবপ্রণীত সংবিধানকে অকার্যকর করার জন্য শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। আর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে পাঞ্জাবের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তাদের সেই যোগ্যতা এখনো বহাল আছে। ক্ষমতা দখলের প্রথম দফায় আভির্ভূত হন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা। তিনি ১৯৫৭ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের মেরুদণ্ডহীন বড় লাট গোলাম মোহম্মদকে বাধ্য করেন পাকিস্তানের নবপ্রণীত সংবিধান বাতিল করে দেশে সামরিক আইন জারি করতে। মির্জার হুকুমমতো গোলাম মোহম্মদ তাই করেন। মির্জার জন্ম মুর্শিদাবাদে এবং তিনি মীর জাফরের সরাসরি বংশধর ছিলেন। মির্জা ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রিসভায় তিনজন বাঙালি ঠাঁই পেয়েছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন এ কে খান, বিচারপতি মোহম্মাদ ইব্রাহীম ও হাফিজুর রহমান। ২৪ অক্টোবর সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে মির্জা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান শপথ গ্রহণ করেন এবং সে রাতেই কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ দখল করেন।

সেনাশাসকরা সব সময় বেসামরিক রাজনৈতিক শক্তিকে ভয় পান। আইয়ুব খানও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই দেশের সব রাজনৈতিক নেতাকে জেলে ভরা শুরু করেন। যেহেতু সে সময় আওয়ামী লীগই ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, তাই এই গ্রেপ্তারের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় আওয়ামী লীগ। বস্তুতপক্ষে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে ছয় দিনের এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে সেই যুদ্ধের অবসান হয়। সেই যুদ্ধে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে সামরিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত পূর্ব বাংলাকে ভারত ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় দখল করে নিতে পারত। এর ঠিক আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খান ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের উভয় অংশের ৮০ হাজার তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রী (বর্তমান সময়ের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যতুল্য) এই নির্বাচনে ভোট দিয়ে আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। ফাতেমা জিন্নাহকে আওয়ামী লীগসহ পাকিস্তানের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সমর্থন করে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকরা এটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে পাকিস্তানের সব অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলারা কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটেই শেখ মুজিবুর রহমান (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু হননি) প্রথমবারের মতো লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলের এক সভায় তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা উপস্থাপন করেন। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।  ছয় দফা শুরুতে তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং তাঁকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়। দলের সভাপতি আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ দল থেকে বের হয়ে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠন করেন। শুধু শেখ মুজিবের যুক্তি ও তা জনগণের সামনে তুলে ধরার তাঁর কৌশলে তা অতিদ্রুত বাংলার জনমানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মুজিব জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ছয় দফা কোনো একটি প্রদেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষার কোনো দাবিদাওয়া নয়। ছয় দফা বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ রক্ষা হবে। শেখ মুজিবের ছয় দফার মধ্যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ভাঙার একটি নীলনকশা আবিষ্কার করে। মুজিবসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেপ্তার করে। শেখ মুজিব যেন সহজে জেল থেকে বের হতে না পারেন সে জন্য ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকা জেল থেকে মুক্তি দিয়ে কারা ফটকে আবার গ্রেপ্তার করে তাঁর বিরুদ্ধে কুখ্যাত আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে। এই মামলাটি ছিল রাষ্ট্রবিরোধী মামলা। আর তা হচ্ছিল ঢাকা সেনানিবাসে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।

এটা অনেকটাই পূর্বনির্ধারিত ছিল যে শেখ মুজিবসহ যাঁদের এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হবে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। রাষ্ট্রদ্রোহের একমাত্র সাজা মৃত্যুদণ্ড। ১৯৬৭ সাল থেকেই পাকিস্তানের উভয় অংশে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কিন্তু শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতা গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার ফলে আন্দোলন নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ঠিক তখনই পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা তুলে নেয় এবং ছাত্রনেতারা শুধু আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বই দেননি, আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে শেখ মুজিবকে তথাকথিত বিচারের মাঝপথে মুক্তি দিতেও বাধ্য করেন। সেই সময়ের ছাত্রনেতাদের যে ধরনের যোগ্যতা ছিল, আর নিজ দল ও লক্ষ্যের প্রতি যে অঙ্গীকার ছিল তার সামান্যতমও বর্তমানে দেখা যায় না। এই ছাত্রনেতারা ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তোফায়েল আহমেদ ইকবাল হল থেকে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ডাকসুতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাতে ধোয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রায় প্রতিদিন ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা করতেন। সঙ্গে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, খালেদ মাহমুদ আলী, আবদুর রউফ, শাজাহান সিরাজ, মাহবুব উল্লাহ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মোস্তাফা জামাল হায়দার। মোনেম খানের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে পরিচিত এনএসএফের নাজিম কামরান চৌধুরী (ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক), মাহবুবুল হক দোলনও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে বেশি দূরে থাকতে পারেননি। রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে খ্যাত সিরাজুল আলম খান সবার গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি সব ছাত্র সংসদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। আইয়ুব খানের পতন না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে দেশের রাজপথ বস্তুতপক্ষে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার দখলে চলে গিয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রধান দাবি ছিল সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার। এসব দাবিকে একত্রিত করে রচিত হয়েছিল ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফা, যার মধ্যে ছয় দফাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৬৯ সালের পর আরেকবার দেশের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে এমন একটি ঐক্য দেখা গিয়েছিল, আর তা ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে প্রথম কাতারের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা, যিনি জেলের বাইরে থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পেরেছিলেন তিনি হচ্ছেন ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ভাসানীকে আটক না করার পেছনে কারণ ছিল, তাঁকে চীনের বন্ধু হিসেবে মনে করা হতো। ছাত্র-জনতা ছাড়াও এই আন্দোলনে টঙ্গী ও আদমজীর শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। এই আন্দোলনকে সফল করতে জীবন দিয়েছে অসংখ্য শ্রমিক। এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয় দৈনিক ইত্তেফাক আর দৈনিক আজাদ (অধুনালুপ্ত)। শেখ মুজিব ঘোষিত ছয় দফা প্রচারের ক্ষেত্রে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা অনবদ্য ও ঐতিহাসিক। যেহেতু রেডিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেহেতু দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক আজাদের মাধ্যমেই দেশের মানুষ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারত। বিদেশি সংবাদ শোনার সুযোগ তেমন একটা ছিল না। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো মিছিল বের করতে না পারে, সে জন্য প্রতিদিন দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে ১৪৪ ধারা ও রাতে কারফিউ জারি করা হতো। কিন্তু ১৪৪ ধারা বা কারফিউ—কোনো কিছুই প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আর যখনই ছাত্ররা মিছিল বের করেছে তখনই পুলিশ-ইপিআর তাদের মিছিলের ওপর গুলি করেছে। অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত বা নিহত হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হন। একই দিনে ঢাকা শহরের অন্যান্য স্থানে গুলিতে সাংবাদিকসহ চারজন নিহত হন। এই দিনের এই হত্যাকাণ্ড পুরো আন্দোলনকে বিস্ফোরণোন্মুখ করে তোলে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৪ জানুয়ারি হরতাল আহ্বান করে। আইয়ুববিরোধী সব আন্দালনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। হরতাল সফল করে তোলার জন্য কখনো তেমন একটা পিকেটিং করতে হয়নি।

২৪ জানুয়ারির হরতাল ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে একটি টার্নিং পয়েন্ট। এই দিন ঢাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। সকাল থেকেই দলে দলে ছাত্র-জনতা মিছিল করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জমায়েত হতে থাকে। সকাল ১০টার পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মিছিল বের হয়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিকসহ আরো তিনজন নিহত হন। এর প্রতিবাদে উত্তেজিত জনতা সরকারের মালিকানাধীন দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক মর্নিং নিউজ ভবনে অগ্নিসংযোগ করে। বস্তুতপক্ষে এই দিন ঢাকার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতার হাতে চলে যায়। দুপুর নাগাদ নামানো হয় সেনাবাহিনী। ২৪ ঘণ্টার জন্য জারি করা হয় কারফিউ। রাস্তায় দেখামাত্র গুলির হুকুম দেওয়া হয়। চলতে থাকে কারফিউ ভাঙার প্রতিযোগিতা আর সমানে গুলি। হতাহতের সংখ্যা ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। সঙ্গে যোগ হয় প্রতিদিন মওলানা ভাসানীর ইমামতিতে পল্টন ময়দানে পুলিশ-সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের জানাজা। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর গুলি থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সামসুজ্জোহা। এই খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই দেশের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সরকার বস্তুতপক্ষে হারিয়ে ফেলে। আইয়ুব খান চিন্তা করেন, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হতে পারে। ২২ তারিখ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে কারাগার থেকে মুক্ত মানুষ হিসেবে মুক্তি লাভ করেন। সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যদেরও মুক্তি দেওয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই জনসমুদ্রে ইতিহাসের মহানায়ককে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। জনগণের বঙ্গবন্ধু জনগণের মধ্যে। সেই জনগণকে আর কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়! তখন পূর্ব বাংলার শাসনভার অনেকটা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হাতে। আইয়ুব খান শেষ চেষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের একটি সমঝোতা বৈঠকের টোপ দিয়েছিলেন, যা সবার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। ২৪ মার্চ আইয়ুব খান এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করেন I can not preside over the destruction of Pakistan. (আমি পাকিস্তানের ধ্বংসের কর্মকাণ্ডে সভাপতিত্ব করতে পারি না) এই বলে তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১০ বছরের ক্ষমতায় থেকে বিদায় নিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থ্যান পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কফিনে একটি বড় পেরেক ঠুকেছিল। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন বাঙালির অগ্নিঝরা ইতিহাসে একটি কালোত্তীর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখকঃ আবদুল মান্নান

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত