3340
Published on জানুয়ারি 16, 2018২০১৪ সালে আইপিইউর ১৩১তম অ্যাসেম্বলিতে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম আইপিইউর প্রেসিডেন্ট হন। একই বছরের অক্টোবরে ক্যামেরুনের ইয়াহুন্ডিতে অনুষ্ঠিত সিপিএর ৬০তম সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, তিনি ছিলেন সংস্থাটির প্রথম নারী প্রধান। গতবছরের ১৪ থেকে ১৮ অক্টোবর রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত আইপিইউর ১৩৭তম অ্যাসেম্বলিতে আন্তর্জাতিক সংসদীয় এই বৃহত্ ফোরামের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন মেক্সিকোর ম্যাডাম গাব্রিয়েলা ব্যারন। আর গতবছরেরই ৭ নভেম্বর ঢাকায় সিপিএর ৬৩তম সম্মেলনে সংস্থাটির নতুন চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন ক্যামেরুনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার এমিলিয়া মনজোবা লিফাঙ্কা। শিরীন শারমিন ছিলেন সিপিএর প্রথম নারী চেয়ারপারসন, আর মনজোবা লিফাঙ্কা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্ এই সংসদীয় ফোরামের দ্বিতীয় নারী চেয়ারপারসন হয়েছেন।
প্রায় একই সময়ে বিশ্বের বৃহত্ এই দুটি সংসদীয় ফোরামের প্রধান পদে শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সাবের হোসেন চৌধুরীর এ অর্জন আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। বিরল এই সম্মান অর্জনের জন্য ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তাদের দুজনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বের ৫২টি স্বাধীন দেশ নিয়ে কমনওয়েলথ গঠিত। ১৯১১ সালে গঠিত হয় সিপিএ। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়োপযোগী প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশ সিপিএর কার্যকর সদস্য হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। অন্যদিকে, ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় আইপিইউ।
গতবছরের ১ থেকে ৫ এপ্রিল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় আইপিইউর ১৩৬তম অ্যাসেম্বলি। ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শেষ হয় আইপিইউর পাঁচ দিনব্যাপী ওই সম্মেলন। সম্মেলন সমাপ্তি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তৈরি হয়েছিল এক অন্যরকম পরিবেশ। বিশ্বের ১৩১টি দেশের সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্যরাসহ আগত পর্যবেক্ষকরা পরস্পরকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে সেদিন বিদায় নিয়েছিলেন। সম্মেলনের শেষদিনে সমাপনী মন্তব্যে প্রত্যেকেই ভূয়সী প্রশংসা করেন বাংলাদেশের আতিথেয়তা ও এদেশের মানুষের হূদয়ের উষ্ণতার। সম্মেলনের সফল আয়োজনে মুগ্ধ প্রতিনিধি দলগুলোর প্রধানরা একবাক্যে সেদিন বলে গেলেন ‘ধন্যবাদ ঢাকা, ধন্যবাদ বাংলাদেশ’।
৫ এপ্রিল সম্মেলন সমাপ্তির পরপরই সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইপিইউর সেইবারের সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধির প্রশ্ন ছিল—এই অ্যাসেম্বলি থেকে বাংলাদেশের সবচেড়ে বড় অর্জন কী? অনেক ভেবে-চিন্তে শিরীন শারমিন সেদিন বলেছিলেন, ‘এই সম্মেলনের আয়োজক বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ, দশম সংসদের আমন্ত্রণেই বিশ্বের সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশে এসেছেন। এই সংসদের প্রতি যে দেশের মানুষের এবং বিশ্বের পরিপূর্ণ আস্থা আছে, সেটি এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো। বিশ্বের সর্বোচ্চ দুটি সংসদীয় ফোরাম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) এবং আইপিইউর প্রধান পদে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত করার মধ্য দিয়েও এটা প্রমাণ হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এদেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান সেটিও আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি।’
সংবাদ ব্রিফিংয়ের আগে সেদিন অ্যাসেম্বলির সমাপনী বক্তব্যে শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই সম্মেলন আমাদের জন্য অনেক সম্মানের। এটা আমাদের সফলতম একটি সভা। সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।’
সম্মেলন থেকে অর্জনের বিষয়ে সমাপনী সংবাদ ব্রিফিংয়ে ইত্তেফাক প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে আইপিইউর তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা ছিল আন্তর্জাতিক পরিসরে সর্ববৃহত্ আয়োজন। অত্যন্ত সফলভাবে এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি, বাংলাদেশ বিশ্বকে নেতৃত্ব নিতে সক্ষম। বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পারাটাই আমাদের বড় অর্জন। জাতি হিসেবে আমরা মর্যাদার উচ্চতর জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছি। তাছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে এতদিন পর্যন্ত অনেকের ধারণা ছিল—এটা তলাবিহীন ঝুড়ির সেই দেশ, এটা বন্যা-খরা-মঙ্গা ও দুর্যোগের দেশ; কিন্তু বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা এসে দেখে গেলেন এসবকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ কত সামনে এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বদলে দিতে পারাও এই সম্মেলন থেকে অনেক বড় পাওয়া।’
আইপিইউর সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুংগং সেদিন সমাপনী বক্তব্যে বলে গেলেন, ‘অত্যন্ত সফল আয়োজন করেছে ঢাকা, এটা একটি ভাগ্যবান শহর। এই সম্মেলনকে ঘিরে আমাদের যেই প্রত্যাশা ছিল তার সবই পূরণ হয়েছে, আমি পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত।’
আইপিইউ সম্মেলনের শেষভাগে ভূ-রাজনীতির হিসাবে ভাগ করা অঞ্চলগুলো থেকে একজন করে সমাপনী বক্তব্য রাখেন। এশিয়া প্যাসিফিকের পক্ষ থেকে দেওয়া সমাপনী বক্তব্যে ভারতের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমি এর আগে আরও কয়েকটি আইপিইউ সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। কিন্তু এবারের সম্মেলনটা আমার দেখা সেরা সম্মেলন। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন। বাংলাদেশের আতিথেয়তা ও সমাদরে আমি অভিভূত। খুব সুন্দর দেশ, অনেক উন্নয়ন দেখে গেলাম।’ ইউরেশিয়ার প্রতিনিধি বলেছিলেন, ‘এরকম একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ঢাকা আয়োজন করতে পারবে কি-না, এনিয়ে আমরা সংশয়ে ছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত সফল একটি সম্মেলন হলো, বিদায় ঢাকা।’ ব্রুনাই প্রতিনিধি বলেন, ‘ঢাকার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ।’ টুয়েলভ প্লাস গ্রুপের পক্ষ থেকে পর্তুগালের ডোরাক বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে ধন্যবাদ, এই শহরটাকে খুব মিস করব।’ আরব গ্রুপের পক্ষ থেকে মরক্কোর প্রতিনিধি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ খুব সুন্দর করে আয়োজন করেছে।’ আফ্রিকান অঞ্চলের পক্ষে উগান্ডার স্পিকার রেবেকা ক্যারান্ডা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ খুব অতিথিপরায়ণ, আমি খুব মুগ্ধ। নিরাপত্তার কারণে শহরটি ঘুরে দেখতে পারিনি। কিন্তু এখানে মেলাটি দেখে এদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি কিছুটা হলেও বুঝেছি।’
এপ্রিলে আইপিইউর সম্মেলনের পর গতবছরই ১ থেকে ৮ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় সিপিএর ৬৩ তম সম্মেলন। সম্মেলনের শেষদিনে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে মিয়ানমার যেন শিগগিরই তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়—বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনা এরকম একটি বিবৃতিতে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন সিপিএ সম্মেলনে আসা প্রতিনিধিরা। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৬৩তম কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্স (সিপিপি) শেষে সিপিএর বিদায়ী চেয়ারপারসন ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা এক বছরে দুটি সফল সম্মেলন করলাম। এ বছরেই আমরা ঢাকায় অত্যন্ত সফলভাবে আইপিইউ ও সিপিএ সম্মেলন করেছি। এটা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। সারাবিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বিশ্ববাসীর কাছে আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আরও পরিণত হতে চলেছে। সবমিলিয়ে আমরা বিশ্বকে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছি যে—আমরা পারি।’
সৌজন্যেঃ ইত্তেফাক