শ্রদ্ধায়-ভালোবাসায় ভাষাশহিদদের স্মরণ করল জাতি

529

Published on ফেব্রুয়ারি 22, 2017
  • Details Image

গভীর রাতও বাধা হয়নি সেই কৃতজ্ঞ স্মরণে। ১৯৫২ সালের ভাই-হারা শোকার্ত জাতির সব পথ যেন মিশেছে শহিদমিনারে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরেই শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে গেছে স্মৃতির মিনার।

ভাই-হারা শোক শক্তিতে জাতি আরেকবার শাণিত হচ্ছে দেশকে এগিয়ে নেওয়া দৃপ্ত শপথে। বাংলাদেশের শহিদ দিবস হলেও সারা বিশ্ব একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। ভেদাভেদ ভুলে নারী, পুরুষ বসন্তে ফোটা ফুলের স্তবক হাতে নিয়ে ধীরপায়ে যাওয়ার পালা। মুখে একুশের আলপনা, মাথায় বাংলাদেশের পতাকা, বুকে কালো ব্যাজ, হাতে ফুল। দীপ্ত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সব শ্রেণি পেশার মানুষ। কণ্ঠে সবার সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ও আলতাফ মাহমুদের সুর করা চির অম্লান সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...’ ভাষা শহিদদের প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে বর্ণিল হয়ে উঠেছে শহিদ মিনারের বেদি।

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহিদদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। এরপর কিছু সময় তারা নীরবে দাঁড়িয়ে বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান।

রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির বহর শহিদ মিনারে পৌঁছায়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একত্রে শহিদ মিনারের মূল বেদীতে উঠে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। এরপর নির্ধারিত সময়ে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শহিদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল কর্মসূচি। এরপরই একে একে ফুল দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

এছাড়াও একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান ঢাকার দুই মেয়র, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান। এরপর ফুল দেয় ক্ষমতাসীন ১৪ দল, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, এটর্নি জেনারেলসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা। এ সময় কূটনৈতিকদের সঙ্গে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এ ছাড়া ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়-মহানগর আওয়ামী লীগ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

হুইল চেয়ারে বসে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাও আসেন ভাষা শহিদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। শহিদ মিনারমুখী মিছিলের সবার কণ্ঠে অমর সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..।’

রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে রাত সোয়া ১২টার দিকে শহিদ মিনার প্রাঙ্গন ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি। এরপর শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহিদ মিনার প্রাঙ্গন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর নামে হাজার হাজার মানুষের স্রোত।

এ সময় সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের প্রধানের নেতৃত্বে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশ ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। প্রথম প্রহরেই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বামপন্থী বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

ভিভিআইপি পদমর্যাদাধারীরা প্রাঙ্গন ত্যাগের পর ধীরে ধীরে শহিদ মিনারে জনতার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে এ সময় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। এ সময় বিভিন্ন ব্যক্তি এমনকি অনেক ক্ষুদে শিশুদেরও পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে দেখা যায়। শহিদ মিনারে পুষ্প অর্পণে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রোভার স্কাউটের বিপুল সংখ্যক কর্মীকে কাজ করতে দেখা যায়।

শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রোভার স্কাউটের বিপুল সংখ্যক কর্মী কাজ করছে। এ ছাড়া যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন।

ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশের শহিদ মিনারেও একুশের প্রথম প্রহর থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয় একুশের প্রথম প্রহর থেকেই। ভাষা শহিদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। জাতি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গর্ব আর শোকের মধ্য দিয়ে পালন করছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি, রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

দেশ বিভাগের পর বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে যে ভাষা চেতনা বেড়ে উঠতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের কূটকৌশলের মধ্যে এ চেতনা পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি শাসকদের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টার মধ্যে ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, সফিউরসহ কয়েকজন তরুণ শহিদ হন। বলা হয়ে থাকে, ভাষা আন্দোলনের পূর্ণতায়ই বপিত হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণার বীজ।

ভাষা শহিদদের আত্মদান এখন বিশ্ব চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৯৮ সালে কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম প্রথম তখনকার জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, সেমিনার, সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ দেশব্যাপী নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। মঙ্গলবার দেশে সাধারণ ছুটি। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কদ্বীপ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংলা বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত