যারা যুদ্ধাপরাধীদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছে তাদেরও বিচার হবেঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

446

Published on ডিসেম্বর 14, 2016
  • Details Image

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বুধবার আওয়ামী লীগের আলোচনায সভায় দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা এ মন্তব‌্য করেন।

তিনি বলেন, “যারা তাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধে অপরাধী। যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার হয়েছে, এদের বিচারও বাংলার মাটিতে ইনশাল্লাহ হবে।”

জার্মানিতে এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অপরাধীদের বিচার হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলতে থাকবে, এই বিচার শেষ হবে না।

“যতই কৌশল আর ষড়যন্ত্র করুক না কেন, তাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, এটা ন্যায়সঙ্গত পথ। ন্যায় ও সত্যের জয় সব সময় হয়, হবে।”

১৯৭১ সালে যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, যাদের নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে অংশ নিয়েছিল বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, সেই দলটিই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আবার বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার পায়।

এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ঘটে সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সময়ে। আর তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের সময় ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী করা হয় দুই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।
আরেক যুদ্ধাপরাধী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সে সময় ছিলেন খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে ফিরলে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরীসহ মোট ছয়জনের ফাঁসি ইতোমধ‌্যে কার্যকর করা হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব‌্যুনালে নিজামীর রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও এই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া ছিল ‘লাখো শহীদদের প্রতি চপেটাঘাতের’ শামিল।

কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় শেখ হাসিনাও বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের যারা লালন-পালন করেছে, যারা রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, যারা তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পাতাকা দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী।

“এদের বিচার হতে হবে। আমি মনে করি, সময় এসে গেছে, দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে। তাতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সদস্যরা।

হত‌্যার আগে বাঙালির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ আলীম চৌধুরীর চোখ তুলে ফেলা হয়; হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ফজলে রাব্বীর হৃদপিণ্ড শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের মধ্যে যদি কিছু বেঈমান জন্ম না নিত, আর আল-বদর, আল-শামস বাহিনী তৈরি না হত, তাহলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পথ-ঘাট চেনা।

“তাদের (হানাদারদের) পথ দেখিয়েছিল, তালিকা (বুদ্ধিজীজীদের) করেছিল এবং তুলে নিয়ে গিয়েছিল আল-বদর, আল-শামস আর রাজাকারের দল।... অত্যাচার করে করে যে হত্যাকাণ্ড চালানো, এগুলোও তাদের পরিকল্পনার অংশ।”

সেই নির্যাতনের বীভৎসতা চিন্তা করলেও শিউরে উঠতে হয় বলে মন্তব‌্য করেন সরকারপ্রধান।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ‌্যে যাদেরকে শেখ হাসিনা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, তাদের কথাও অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন তিনি।

“আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশাসহ অনেক শিক্ষককে তারা হত্যা করেছে। তাদের ক্লাশ করেছি, টিউটোরিয়ালে ছিলাম।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বলা হত না। বলা হত শুধু হানাদার বাহিনী।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষ অলম্বন করে জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়া শাহ আজিজুর রহমানকে পরে জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রধানমন্ত্রী করার কথাও শেখ হাসিনা বলেন।

জিয়াউর রহমানের সময়ে সামরিক অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয় সে সময়। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ আংশিক সংশোধন করে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের ভোটের অধিকার।

প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সুরে বলেন, “যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায়, সে জাতি সামনে এগোবে কীসের ভিত্তিতে!... মুক্তিযুদ্ধের গান মানুষ ভুলেই যেতে বসেছিল, মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলেই যেতে বসেছিল।”

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে ত্যাগী নেতা-কর্মীদেরও স্মরণ করেন দলীয় সভাপতি।

“প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগের অগণিত নেতা-কর্মী দিনের পর দিন সংগ্রাম করে গেছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর আর্দশ বুকে ধারণ করে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। আমি আপনাদের সামনে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। একটার পর একটা হামলা হয়েছে। আমাকে রক্ষা করেছে এই দলের নেতা-কর্মীরাই। কখনো তো কেউ ভয় পেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায় নাই।”

শেখ হাসিনা বলেন, “সবাই বিকিয়ে যায়নি, সবাই বিকিয়ে যায় না, সবাই বিকিয়ে যেতে পারে না; তাহলে বাংলাদেশ এই জায়গায় আসতে পারত না।”

মাঝখানে ‘কালো মেঘ’ এলেও তা সরে গেছে মন্তব‌্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আশা করি, এই মেঘের ঘনঘটা আর কখনো আসবে না। আর এলেও বাংলাদেশের মানুষ পারবে তা মোকাবেলা করতে।”

শহীদ বুদ্ধিজীবী আর দেশের জন‌্য প্রাণ দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করতে এসে শেখ হাসিনা তার বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কথাও মনে করেন।

“বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে আমি দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে বসি। একটা প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই খুঁজে পাই না। যে বাঙালির জন্য আমার পিতা সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, তার বুকে কিভাবে গুলি চালানো হল! তাকে গুলি করে ওই সিঁড়ির ওপর ফেলে রেখে দিল!

“তিনি তো কোনোদিন এটা বিশ্বাসই করতে চাননি, ভাবতেও পারেননি যে, এই বাঙালির কেউ তার বুকে গুলি চালাতে পারে।”

যখন কেউ জীবনের ওপর হুমকির বিষয়ে সতর্ক করতেন, বঙ্গবন্ধু সেসব আমলে নিতেন না বলে জানান তার মেয়ে।

“কতজন, কত সময়, কত কথা তাকে বলেছে।... উনি বলতেন, ‘ওরা আমার ছেলের মত, আমাকে কেন মারবে?’"

শেখ হাসিনা বলেন, ১৬ ডিসেম্বর যাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল, তারা ওই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট।

ছবিঃ ফোকাস বাংলা

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত