জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলুনঃ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

459

Published on জুলাই 28, 2016
  • Details Image

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি ও পথ সন্ত্রাসের পথ এটা তাদের পথ না (ভাল ঘরের শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের) তারা সুস্থভাবে জীবন-যাপন করবে- এটাই হচ্ছে আসল পথ। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম.. সেইভাবে একটা জনসচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব আমি আপনাদের দিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশ দুর্নীতি মুক্ত হোক, উন্নত হোক।

তিনি প্রশাসনিক সার্ভিসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আশা করি আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় সংসদ ভবনস্থ পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন’র বার্ষিক সম্মেলন-২০১৬’তে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আরও বক্তৃতা করেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। স্বাগত বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. মোশাররফ হোসেন।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ ও হুইপ, জাতীয় সংসদ সদস্য, মুখ্য সচিব সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বাংলাদেশ অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, অত্যন্ত দু:খের বিষয় দেশের এই উন্নয়ন অগ্রগতির সময়ে এক ঘটনা আমাদের একটু থমকে দেয়-জঙ্গি হামলা।

আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি এবং সশস্ত্র বাহিনী তাঁদের ত্বরিত পদক্ষেপের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ১০ ঘন্টার মধ্যে আমরা এই অবস্থা থেকে (জিম্মী দশা) থেকে উত্তোরণ ঘটাতে সক্ষম হই। আমরা যেমন জিম্মীদের জীবন্ত উদ্ধার করতে পেরেছি, যদিও ২০ জন মারা গেছে, সেখানে বিদেশীও ছিল- এটা অত্যন্ত দু:খজনক। কিন্তু, তারপরেও সেই জঙ্গিদের আমরা দমন করেছি। আর একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল (কল্যাণপুরে) সেখানে গোয়েন্দা রিপোটর্টের ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ত্বরিত পদক্ষেপে আমরা রক্ষা পেয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলা, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার হামলার ঘটনা উল্লেখ করে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এসব ঘটনা মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ত্বরিৎ পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আজকে কিছু লোক এই ধর্মের নামে খুন খারাপি করে আমাদের ধর্মটাকেই একটা বদনামের ভাগীদার করে দিচ্ছে। আজকে সারাবিশ্বে ইসলাম ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করছে, ইসলামকে ব্যবহার করে এর ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে মানুুষ হত্যা করে আমাদের পবিত্র ধর্মকে তারা কলুষিত করছে।

আপনারা যারা মাঠ পর্যায়ে কর্মরত-আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে স্ব-স্ব কর্মস্থানে, আপনাদের সাথে যারা কাজ করে এবং যেসব জনগণ আপনাদের সাথে নানা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত থাকে আপনারা সেখানে জনগণের মাঝে একটা জনসচেতনতা সৃষ্টি করবেন, আমরা ইতোমধ্যেই এজন্য নির্দেশনা দিয়েছি। যে কারও ছেলে মেয়ে যাতে এই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের সাথে সম্পৃক্ত না হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী কোমলমতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা লেখাপড়া শিখবে, মানুষের মত মানুষ হবে।

তিনি এ সময় বিনাপয়সায় বই বিতরণ থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তিপ্রদান সহ শিক্ষা সম্প্রসারণে তাঁর সরকারের নানা পদক্ষেপ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরে বলেন, আমরা চাই আমাদের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এদেশকে উন্নত করবে এবং ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব প্রদান করবে।

তিনি বলেন, জঙ্গিরও পথ, সন্ত্রাসের পথ, এটা তাদের পথ না। তারা সুস্থভাবে জীবন-যাপন করবে- এটাই হচ্ছে আসল পথ। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও খুনকে কখনই প্রশ্রয় দেয় না। কাজেই সেইভাবে একটা জনসচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব আমি আপনাদের দিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশ দুর্নীতি মুক্ত হোক, উন্নত হোক। এক্ষেত্রে বহু পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি, আমাদের কর্মসূচিগুলো যেন দ্রুত বাস্তবায়িত হয় তার পদক্ষেপও আমরা নিয়েছি।

তিনি অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ সার্ভিসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আশা করি আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি এই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

দীর্ঘদিন সুবিধাবঞ্চিত এই বাঙালি জাতি এখন একটু আলোর মুখ দেখছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের মধ্যে এতদিনে একটু আস্থা ফিরে এসেছে। তাদের জীবনটা যেন একটু উন্নত হয়। সেই দিকেই আপনারা একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় পাকিস্তান আমলে এদেশের সিভিল প্রশাসন এবং সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙালিদের করুণ বৈষম্যের শিকার হওয়ার চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালিদের সঙ্গে বৈষম্য করা হতো, উচ্চপদে বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন অনেক কম। অথচ উৎপাদন ও রফতানি আয়ের সিংহভাগ পূর্ব পাকিস্তানে হতো’।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ বৈষম্য দূর করে অধিকার আদায়ে জাতির পিতা ২৩টি বছর সংগ্রাম করেন, আন্দোলন করেন। এজন্য কারাবরণ করতে হয় তাঁকে, বক্তৃতা দিলেই মামলা হত, ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়’।

কলেজ, মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসাকেন্দ্র- সবকিছুতেই বাঙালিরা চরম বৈষম্যের শিকার হয়।

অন্যদিকে এদেশের টাকায় পকিস্তানের রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদে তৃতীয় দফায় স্থানান্তর হয়। আমাদের অর্থে করাচিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হয়। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন এবং বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দেয়ার পর বাঙালিদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয় বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বাধীনতা কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং গ্রেফতার হবার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু পূর্ব থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সকল আয়োজন করে রেখেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন বাঙালির ৬ দফা পাকিস্তানীরা মানবে না।

শেখ হাসিনা বলেন, যে পাকিস্তানিরা আমাদের অবহেলা করতো, তাদের কাছেই পাকবাহিনীতে আত্মসমর্পণ করতে হয়। বাঙালি দেখিয়ে দেয় যে, আমরাও পারি। জাতির জনক যে বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা, তারা পারেনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্যই আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনিই আমাদের দিয়ে গেছেন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত, একটি আধুনিক সংবিধান।

দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই আজ সরকারের প্রশাসনে এবং সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালিরা উচ্চপদে আসীন হতে পেরেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই দেশের জনগণ প্রথম জানতে পারে ক্ষমতাসীনরা দেশের শাসক নয়, সেবক। কিন্তÍু, ২০০১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে আর্থ সমাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা-দীক্ষা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দারিদ্র হ্রাস সবকিছুতেই বাংলাদেশ আবার পিছিয়ে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের আর্থসমাজিক উন্নয়নের তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, আপনারা জানেন- আমাদের গণমুখী কর্মসূচির ফলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৯ সালের ৮৪৩ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার হয়েছে। আয় বৈষম্য কমেছে। নিশ্চিত হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৩০ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। চলতি অর্থবছরে আমরা ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছি। গত অর্থবছরে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৪ হাজার ৪২৯ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ১০৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৭৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ঘরে ঘরে আলো জ্বালাবো, এটাই আমাদের লক্ষ্য।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে অতিরিক্ত ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে প্রায় ১ কোটি মানুষের। সেই সাথে নতুন নতুন রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নকেও আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।

তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এই উন্নয়নের অংশীদার উল্লেখ করে বলেন, আপনারা দ্রুত প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন বলেই এই স্বল্প সময়ে দেশের এতটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।

তিনি এ সময় মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট (বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১) উৎক্ষেপণ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতায় আসার পর দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ সহ আওয়ামী লীগ সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষা খাত, খাদ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং দারিদ্র হ্রাসে দেশকে পিছিয়ে ফেলার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, তারা লুটপাট মানি লন্ডারিং নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে দেশের উন্নয়ন এক কদমও আগে বাড়েনি। উপরন্তুু, আমাদের রেখে যাওয়া অবস্থান থেকেও দেশকে পিছিয়ে দিয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমি আশা করি- বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সদস্যগণ দেশপ্রেম, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। দেশের যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখতে হবে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁরা আরও নিবেদিত হবেন বলেও প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত