691
Published on মে 18, 2016তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে নারী ও বালিকাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষাসহ দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং তাদের ক্ষমতায়নে আমাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে আন্তরিক অঙ্গিকার এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্যও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আসুন নারীর জন্য একটি সুষ্ঠু বিশ্ব গড়ে তুলতে আমরা নতুন করে অঙ্গিকার করি, যেখানে আমরা মর্যাদার সঙ্গে এবং সকল প্রকার ভয়-ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে বসবাস করতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রী বুধবার বিকেলে এখানে ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে ‘গ্লোবাল উইমেন লিডার্স ফোরাম’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মূল বক্তব্যে এ আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজিএস) অর্জনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে গত বছর নিউইয়র্কে আমরা একটি পরিবর্তনশীল এজেন্ডা ২০৩০ গ্রহণ করেছি। নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে নতুন এজেন্ডা উপস্থাপন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একমাত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জন করতে পারি।
অনুষ্ঠানে বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট রোজেন প্লেভনেলিয়েভ, উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং শ্রম ও সামাজিক নীতিবিষয়ক মন্ত্রী ইভায়লো কালফিন, জ্বালানি মন্ত্রী টামেনুজকা প্যাটকোভা, আঞ্চলিক উন্নয়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী লিলিয়ানা পাভলোভা, ইনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকভা, বুলগেরিয়া জাতীয় পরিষদের চেয়ারম্যান ট্যাসটাসকা টাচেভা এবং সিমেন্স বুলগেরিয়ার সিইও ও সে দেশের কাউন্সিল অব উইমেন ইন বিজনেসের চেয়ারপার্সন বুরিয়ানা ম্যানোলোভাও বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ভেঙ্গে লিঙ্গ সমতা বিধানে বদ্ধ পরিকর।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার নারী উন্নয়নে উচ্চাভিলাষী নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেখানে নারী এবং পুরুষের সমান সুযোগ সৃষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালায় আমরা নারী শিক্ষা এবং নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশিচত করার পাশাপাশি তাদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলায় সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে তাঁর সরকার জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং জাতীয় বাজেটেও নারী উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করেছে।
তিনি বলেন, আমাদের জিডিপি’র শতকরা ২ শতাংশ আমরা নারীর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় করছি। যার সুবিধাভোগী ভাগ্য বঞ্চিত অসহায় দরিদ্র নারীগোষ্ঠী।
নারী শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নারী শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছে এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও অবৈতনিক নারী শিক্ষা চালু করা সরকারের পরিকল্পনাধীন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাধ্যমিক থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েট লেভেল পর্যন্ত দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন প্রকার মেধাবৃত্তি প্রদানের আওতায় আনা হয়েছে। ..দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে টিফিন প্রদান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে ঝরেপড়া কমেছে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক দ্বারা পূরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কার্যকর পদক্ষেপ এবং ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে নারীর বিদ্যালয়ে যাবার হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত হয়েছে।
শিক্ষার পাশাপাশি সরকার মাতৃস্বাস্থ্য এবং পুষ্টির দিকেও নজর দিচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, সারাদেশে হাসপাতাল স্থাপনের অংশ হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৬ হাজার ৫শ কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীদের প্রসূতি সেবাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ‘মেটার্নাল হেলথ ভাউচার স্কিম’ চালু করেছে। যার মাধ্যমে গর্ভধারিনী মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে নিরাপদ সন্তান প্রসব এবং প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও সরকার ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশই বিশ্বে সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে সংসদ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেতা এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী।
তিনি বলেন, বর্তমান সংসদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৭০ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। যা মোট সদস্যদের শতকরা ২০ ভাগ। আমরা ২০২০ সাল নাগাদ সকল রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নির্বাচিত নারী সদস্য কর্মরত রয়েছেন। এই বাস্তবধর্মী পদক্ষেপের ফলে আমরা সমাজের প্রথাগত মন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। আগে যেখানে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণকে ভালো চোখে দেখা হত না।
বর্তমান পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন পরিবারের অন্য সদস্যরাও নারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে এবং নিজেরাও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়।
প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পেশায় নারীদের সাফল্যজনক অংশগ্রহণের প্রসংগ উল্লেখ করে বলেন, সমাজের সকল পেশার ক্ষেত্রেই নারীদের অংশ গ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশ্রস্ত্রবাহিনী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিভিন্ন কারিগরি ক্ষেত্রেও নারীরা উচ্চপদে আসীন রয়েছে।
দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিকতায় যুক্ত রয়েছে বহু নারী.. খেলাধুলায় বিশেষ করে ক্রিকেট, ফুটবল এমনকি উচ্চপর্বতশৃঙ্গ জয়েও এগিয়ে এসেছে নারীরা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের নারীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও কর্মরত রয়েছে। পাশাপাশি নারী কূটনৈতিক, বিমানের বৈমানিক, শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের নারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থেকে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রাখছেন।
যে কারণে, এদেশের নারীরা সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জাতীয় উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে সমর্থ হচ্ছে এবং জাতি গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সকল গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের সামনে এখনও বড়ো চ্যালেঞ্জ.. আমরা এখনও পুরোপুরি কার্যকর অর্থে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বাল্যবিবাহ কিংবা নারী ও মেয়ে পাচার বন্ধ করতে পারিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার অবশ্য এই সামাজিক দুষ্ট ক্ষত দূর করতে বিভিন্ন কঠোর আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রশাসনিক বিধিবিধান প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, আমরা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এসব অপরাধ এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বারোপ করছি। এসব ক্ষেত্রে তাঁর সরকার ভিকটিমকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রেখে আইন প্রণয়ন করেছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বাল্যবিবাহ বন্ধে তাঁর সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আভাস দিয়ে বলেন, যত শিগগির সম্ভব বাংলাদেশ থেকে এই বাল্যবিবাহ চিরতরে বন্ধে তাঁর সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।