350
Published on এপ্রিল 7, 2016তিনি বলেন, ‘আমরা সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার একজন মানুষকেও যাতে খাদ্যের অভাবে প্রাণ হারাতে না হয়, সে লক্ষ্যে সার্ক খাদ্য ব্যাংক হবে আমাদের বিপদের বন্ধু।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় একটি অভিজাত হোটেলে ৩য় সার্ক কৃষিমন্ত্রী পর্যায়ের সভার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকদের হাতে শস্যবীজের অধিকার সংরক্ষিত রাখার জন্য একটি ‘সার্ক বীজ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার জন্যও নেতৃবৃন্দের প্রতি আহবান জানান।
বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে তিনদিন ব্যাপী এ বৈঠকের আয়োজন করেছে।
কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভারতের কৃষি এবং কৃষক কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী রাধা মোহন এবং সার্ক মহাসচিব অর্জুন বাহাদুর থাপা বক্তৃতা করেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী এই অঞ্চলের দেশগুলোর দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা দূরীকরণে একযোগে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই একটি মানুষও যেন অনাহারে না থাকে, অপুষ্টিতে না ভোগে। আমরা প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চাই। কিন্তু কোন একক দেশের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ।’
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সবসময়ই আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
তিনি আরো বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় এক রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি প্রথম তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন থেকেই বাংলাদেশ তার বৈদেশিক নীতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে আমাদের বেশ কয়েকটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। এগুলো হচ্ছে- ১. স্বল্প দামে উন্নত বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। ২. কৃষি কাজে সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনা। ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি। ৩. রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব-পদ্ধতির কৃষির প্রবর্তন। ৪. কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ। ৫. কৃষি উৎপাদন খরচ হ্রাস। ৬. কৃষক পর্যায়ে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ। ৭. কৃষি বিপণন ব্যবস্থা জোরদার। ৮. প্রান্তিক চাষীদের স্বার্থ সুরক্ষা। ৯. গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি এবং মাছের রোগ প্রতিরোধসহ উন্নত চাষ পদ্ধতি চালু করা এবং ১০. এসব কর্ম সম্পাদনের জন্য উন্নততর গবেষণা পরিচালনা করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সার্কভুক্ত বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনীতি এখনও প্রধানত কৃষিনির্ভর। যদিও কোন কোন দেশের জিডিপি-তে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য ও পুষ্টির যোগান এবং শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষি এখনও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে’।
শেখ হাসিনা বলেন,‘ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যের অবস্থান শীর্ষে। সভ্যতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য সত্ত্বেও আজও বিশ্বের সকল মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে এখনও প্রায় ৮০৫ মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। অর্থাৎ প্রতি ৯ জনে একজন অপুষ্টিতে ভুগছেন। আবার এরমধ্যে ৭৯১ মিলিয়ন মানুষের বসবাস উন্নয়নশীল দেশে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২৭৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ এই অপুষ্টিতে ভোগার দলভুক্ত।
খাদ্য নিরাপত্তার সংগে কৃষি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একইসঙ্গে এটি একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল বিষয়। আমি আশা করব, এই বৈঠকে অংশ গ্রহণকারী মন্ত্রী এবং বিশেষজ্ঞ মহল আলোচনার মাধ্যমে এমন কিছু সুপারিশ দেবেন, যা এই অঞ্চলের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশীয় জনগণের জন্য খাদ্য এবং পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানই হোক আমাদের এই সম্মেলনের অঙ্গীকার।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত আইনী কাঠামো প্রণয়ন ও প্রয়োগে আমার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি দক্ষিণ এশিয়াকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাফল্যের পর আমরা গত বছর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি গ্রহণ করেছি। এর ১ এবং ২ নম্বর ধারায় অতি দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা নিবারণের বিষয়টি প্রাধিকার পেয়েছে। সবার জন্য খাদ্য-পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য কৃষি উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপি-তে কৃষির অবদান বর্তমানে প্রায় ১৬ শতাংশ। গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষিই এখনও প্রধান অবলম্বন।’
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত এক দশকে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩ গুণ এবং শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ। বছরে ৩৪ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন করে আমরা চাল উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছি। বর্তমানে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে আমরা বিদেশে সীমিত পরিমাণ হলেও চাল রপ্তানি শুরু করেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরণের ক্ষেত্রে চতুর্থ এবং চাষের মাধ্যমে মাছ আহরণের ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। গত ৩ দশকে মাছের উৎপাদন প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বাৎসরিক উৎপাদন ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। একইসঙ্গে গবাদি-পশু এবং হাঁস-মুরগী খাতে বিশেষ করে মাংস, ডিম এবং দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, আমাদের বিজ্ঞানীগণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম বেশকিছু ফসলের জাত এবং কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের পাটের জন্ম-রহস্য উন্মোচন কৃষি গবেষণা এবং উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশেও একই ধরনের সাফল্য রয়েছে। আমরা সবার কল্যাণের জন্য এগুলো বিনিময় করতে পারি। এ অঞ্চলে টেকসই কৃষির উন্নয়ন এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের মধ্যে আরও গভীর সহযোগিতার প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা নানা কারণে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উচ্চমাত্রার দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্র-বেষ্টিত এবং সমুদ্র-উপকূলীয় দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখী হতে পারে।
তিনি বলেন, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিধস এবং ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোন সময় আমাদের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না, কিন্তু এসব দুর্যোগের কারণ হ্রাস এবং দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা এবং মানবসম্পদের উন্নয়ন দারিদ্র দূরীকরণের উৎকৃষ্ট উপায়। তিনি এ বিষয়ে দেশে তাঁর সরকারের গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপের খন্ডচিত্রও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির ৬ শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে আমরা ৭.০৫ শতাংশে উন্নীত করেছি। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের ৫৪৩ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৬ ডলার হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসসহ বেশিরভাগ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৫ সালে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সারাদেশে অসংখ্য ভোকেশনাল ইনস্টিটিউিট গড়ে তোলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য আমরা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করেছি। চলতি অর্থবছরে এখাতে ৩০৭ দশমিক ৫১ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা এ অগ্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সারিতে আমাদের আসন নিশ্চিত করতে চাই।’
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল