729
Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2016প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষার বিকৃতি যেন না হয সেজন্য সবাইকে সচেতন থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। এ বিষয়ে আরো সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার বিকেলে ভাষা শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা-দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এই প্রতিষ্ঠানটি হবে সারাবিশ্বের মাতৃভাষা চর্চার, মাতৃভাষা গবেষণা করার পাদপিঠ।
তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান যেন কেউ বন্ধ করতে না পারে সে লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করেছি। এ প্রতিষ্ঠানটা যাতে ভালভাবে কার্যক্রম চালাতে সে ব্যবস্থাও আমরা করেছি। প্রয়োজনীয় ফান্ডের ব্যবস্থাও করবো।’
তিনি অনুষ্ঠানে বিকৃত উচ্চারণে বাংলা শব্দের উচ্চারণকারীদের তীব্র সমালোচনা করে বলেন,
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান অনুষ্ঠানে ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙালি মননের বাতিঘর’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ইউনেস্কোর ঢাকা অফিসের প্রধান বিয়াট্রিস কালডুন শুভেচ্ছা বক্তৃতায় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক মিজ ইরিনা বুকোভার শুভেচ্ছা বাণী অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক জিনাত ইমতিয়াজ আলী ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ, মন্ত্রী পরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর এবং স্বায়ত্ত শাসিত প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কমৃকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাঙালিরা সব সময় বাংলায় কথা বলবো, মায়ের ভাষাতেই কথা বলে যাবো, মাকে মা বলে ডাকবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ভাষা ভিত্তিক দেশ। আমরা আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি।
ভাষাশহিদের আত্মত্যাগের বিষয়টিকে সম্মান জানিয়ে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাদের ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কষ্ট হয় তখনই যখন দেখি মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষাকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। যেন বাংলা ভুলে যাওয়া গুণের কাজ! মানুষ আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করবে। এটি তার নিজস্ব এলাকার ভাষা- কিন্তু বাংলাকে ভুলে যাবে না। এছাড়া জীবন জীবিকার জন্য নতুন নতুন ভাষা শিখতে হবে।
তিনি বলেন, ভাষা শেখায় অপরাধ নেই। যে যত ভাষা শিখতে পারবে ততই উন্নতি। কিন্তু এখনকার মানুষজনের মধ্যে একটি জিনিস লক্ষ্য করি তা হলো- ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের না পড়ালে যেন ইজ্জতই থাকে না।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, এ সময় কয়টা ছেলে-মেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে?
প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে বিকৃত করে ইংরেজি ধাঁচে বলার প্রবণতা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ভাষা রক্ষার কাজ এবং গবেষণা বাড়াতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের সব ভাষা রক্ষার দায়িত্ব এখন আমাদের ওপর। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইউনেস্কোর ক্যাটাগরি-২ তে অন্তর্ভূক্ত হবার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠে আসায় তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকায় চায় এখানে গবেষণা হোক। পাশাপাশি আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষার গবেষণাও এখানে করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এই দেশ আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ভাষা ব্যবহার ও চর্চায়, সংবাদমাধ্যম যেন সচেতনতা তৈরি করে আমি সে আহ্বান জানাবো। এছাড়া ধন্যবাদ জানাই যারা মোবাইল ফোনে বাংলায় এসএমএস পদ্ধতি তৈরি করেছেন তাদের। এটি আমাদের সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ আন্দোলনের শুরুতেই চারবার কারাবরণ করেন বঙ্গবন্ধু। এ আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জনকারী রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কোনো অর্জনই সহজে আসে না। তাদের রক্তেই আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে পেয়েছি ।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ একটি ভাষাভিত্তিক দেশ। মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্ব, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। তাই ভাষার উপর পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের আঘাত ছিল পরিকল্পিত। এর মাধ্যমে তারা আমাদের আবহমান সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় শুনেছিলাম উর্দ্দু হরফে নাকি বাংলা লিখতে হবে। এরপর আরবী এবং পরে ল্যাটিন অক্ষরেও বাংলা লেখার চেষ্টা করায় পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী।’
কিন্তু, মাতৃভাষাপ্রেমী এদেশের মানুষ ভাষার উপর আগ্রাসন মেনে নেয়নি। শুরু হল দুর্বার ভাষা আন্দোলন।
প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সে সময়েও কিছু বাঙালি পাকিস্তানী শাসকদের তাবেদারি করেছিল। পাকিস্তানীদের পদলেহন না করলে যেন তাদের মন ভরতো না। এই শ্রেনীর কেউ কেউ এখনও আমাদের সমাজে রয়েছেন।
জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার প্রস্তাবে ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশ ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট ডাকে। সচিবালয়ের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, গণআন্দোলন সফল করতে দূরদর্শি যে নেতৃত্বের প্রয়োজন বাঙালি জাতি সেই নেতৃত্ব পেয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কখনও জেলে, কখনওবা হাসপাতালে থেকেই বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ভাষা আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তিনি ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে ১১ দিন একটানা অনশন করেন।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সেই দুর্বার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনের দিন শাসকগোষ্ঠীর জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গিয়ে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারসহ আরও অনেক বীর ভাষাযোদ্ধা প্রাণ হারান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়, স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণেরও উদ্যোগ গ্রহণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের জন্য দীর্ঘ ২৩ বছরের পথ পরিক্রমায় ঐতিহাসিক ৬ দফা এবং ১১ দফার আন্দোলন, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের মার্শাল ’ল’ জারি করে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে প্রেরণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান-অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়েছে। যার সূচনা ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। চূড়ান্ত সাফল্য ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে।
২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার নেপথ্যে প্রধানমন্ত্রী কানাডা প্রবাসী সালাম এবং রফিক তাদের সংগঠন ’ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার অব দি ওয়ার্ল্ড’ এর কথা স্মরণ করেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আবহমান ঐতিহ্য আবার প্রাণ পায়। আমাদের পদক্ষেপের ফলেই ইউনেস্কো ১৯৯৯ সনের ১৭ নভেম্বর বাঙালির মহান ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ উদ্যোগের প্রথম দিকে কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিক ও সালাম এবং মাতৃভাষা প্রেমিক গোষ্ঠী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। আমি তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।’
তিনি বলেন, ইউনেস্কো-র সঙ্গে যোগাযোগের এক পর্যায়ে তাঁরা জানান, এ প্রস্তাব কোন সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে আসতে হবে। আমি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এ এইচ কে সাদেক সাহেবের মাধ্যমে অবহিত হওয়া মাত্রই অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং সফল হই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্নাত গৌরবের সুর বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে-আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা আর আলতাফ মাহমুদের সুর করা কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। আমি কি ভুলিতে পারি ?’
তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবী আজ বাংলাদেশকে জানে। বাংলা ভাষার গৌরবের কথা জানে। মহান ২১শে ফেব্রুয়ারির কথা জানে। বাঙালির বীরত্বের কথা জানে। সে এক মহান অর্জন।’
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রেক্ষাপট স্মরণ করে ২০০১ পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামাতের এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়ারও সমালোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী আগামীদিনের সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য স্কুলে স্কুলে খেলাধুলার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চাতেও ছেলে-মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষক-অবিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, খেলাধূলা ও সংস্কৃতি চর্চায় থাকলে ছেলে-মেয়েরা আর বিপথে যেতে পারবে না। ড্রাগ বা জঙ্গিবাদের বিষবাষ্প থেকেও তারা রক্ষা পাবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সোনার নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে।