844
Published on নভেম্বর 8, 2015প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এ সফর দু’দেশের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দান করেছে এবং বিশ্ব অঙ্গনে বিশেষ করে ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ সফরের ফলে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরো বিস্তৃত, দৃশ্যমান ও সুসংহত হয়েছে।’
শেখ হাসিনা রোববার গণভবনে তাঁর ৩ দিনের নেদারল্যান্ডস সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন। তিনি ৩ নভেম্বর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশটি সফর করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. নজরুল ইসলাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অন্যান্যের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেদারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে তাঁর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ও বৈশ্বিক বিষয়ে আলোচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও বন্ধুত্বপূর্ণ। ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই ব-দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে উভয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী খনন, চর উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে নেদারল্যান্ডের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা, কৃষি খামার গ্রীন হাউজ ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র পরিদর্শন এবং কয়েকটি সমঝোতা স্মারক ও আগ্রহপত্র স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ইউনেস্কো দ্বিতীয় গ্রেড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ম্যাচে বিজয়ের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট দল, নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী খেলোয়াড় এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী দু’দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐকমত্যের বিষয়গুলোর উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ সঠিকভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা আরও গভীর, জোরদার ও বিস্তৃত করা।
তিনি বলেন, নেদারল্যান্ডস ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসরমান দেশ। ব-দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নেদারল্যা-সের কর্মপদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে ব্যবহার উপযোগী হবে বলে আমরা মনে করি। এতে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর অধীনে ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সক্ষমতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনী কৌশল বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োগ করে যেতে পারে। যা বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে আমাদের এ ব-দ্বীপকে নিরাপদ ও উৎপাদনশীল রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সহায়ক হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র ও নদী থেকে ভূমি সংযোজন ও পুনরুদ্ধার, ভূমি সংরক্ষণ, কৃষি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা সম্প্রসারিত করা এবং নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০ বাস্তবায়নের জন্য একটি ডেল্টা কমিশন এবং প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য একটি ডেল্টা ফান্ড গঠনের বিষয় আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। এ কমিশন পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সমুদ্র ও নদী থেকে ভূমি সংযোজন ও পুনরুদ্ধার, ভূমি সংরক্ষণ, কৃষি ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট উন্নয়নে ঐকমত্যের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেত্রে নেদারল্যা-সের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে টেকসই শিল্পে পরিণত করতে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ বিষয়ে তাদের চলমান সহযোগিতা আরও জোরদার করার কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (রুটে)আমার সাথে একমত যে, শুধু সরকার ও পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়নে কাজ করলে যথেষ্ট হবে না। যথাযথ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে একটি দায়িত্বশীল গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী রুটে।
তিনি ব-দ্বীপ অঞ্চলে বৈরি পরিবেশে কৃষি ক্ষেত্রে সফল নেদারল্যা-সের ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী কৌশল বাংলাদেশে প্রয়োগ করে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদারে ঐকমত্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ক্ষুদ্র (সাড়ে তিনভাগের চেয়েও ক্ষুদ্র) হওয়া সত্ত্বেও কৃষিপণ্য রফতানিতে নেদারল্যান্ডস বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এজন্য কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
শেখ হাসিনা এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার মান বৃদ্ধিতে দুগ্ধ, হাঁস-মুরগি, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ ইত্যদি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণে নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। তিনি সেখানে তার কৃষি খামার, গ্রীন হাউজ ও কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র পরিদর্শনের কথাও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা, বাংলাদেশী জুনিয়র কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ, বস্ত্রশিল্প এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং বিষয়ে ৪টি সমঝোতা স্মারক ও আগ্রহপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
এরমধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ‘ফরেন অপিস কনসালটেশন্স’ বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশের জুনিয়র কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সহযোগিতা বিষয়ক আগ্রহপত্র, বাংলাদেশের বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির সঙ্গে নেদারল্যা-সের স্যাক্সন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেসের মধ্যে সমঝোতা স্মারক এবং বাংলাদেশের বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের স্যাক্সন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস, স্কুল অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডসের রাজকীয় বাসভবনে রাণীর তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় দেশটির রাজাও উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, সাক্ষাৎকালে নেদারল্যান্ডসের রাণী অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূঁয়সী প্রশংসা করেন। বিশেষ করে তিনি (রাণী) বাংলাদেশের জনগণের অনগ্রসর অংশের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের আশ্রায়ন, দুস্থমাতা, বিধবা, শারীরিকভাবে অক্ষম বৃদ্ধদের জন্য ভাতা, খাদ্য সাহায্য ইত্যাদি পদক্ষেপেরও ভূঁয়সী প্রশংসা করেন।
তিনি অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের কর্মসূচি বিশেষভাবে তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের মহাসচিচের ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে বিশেষ দূত হিসেবে রাণী ম্যাক্সিমা এ মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সফর করবেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী লিপিয়ান্নে প্লউমের এবং অবকাঠামো ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী মেলানী সুলজ-এর সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, প্লউম বাংলাদেশের রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণ ও অধিকতর মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে হায়ার ভ্যালু চেইন-এ উন্নীতকরণে নেদারল্যান্ডসের অধিকতর সহযোগিতা এবং অবকাঠামো ও পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি ও নিবিড় কাজ করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান ২১০০ এবং নেদারল্যান্ডস ডেল্টা প্ল্যানের তুলনামূলক আলোচনা অনুষ্ঠানে তাঁর অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলেন, এর মাধ্যমে দেশটির ডেল্টা প্ল্যানের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আরও কার্যকর করা সম্ভব হবে।
তিনি তার নেদারল্যান্ডসের রটারডামে নদী ও সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার ও সংযোজনের মাধ্যমে স্থাপিত এপিএমটি সমুদ্রবন্দর পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নেদারল্যান্ডসের ৪০ জন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিক এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের জন্য আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উত্তরণ : অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে যোগদান করেন এবং এতে দু’দেশের বক্তারা বাংলাদেশকে ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
বক্তারা কৃষি, শিল্প, অবকাঠামো ও পানিসম্পদ এ চারটি খাতকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় হিসেবে চিহ্নিত করেন। পাশাপাশি সেমিনারে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে তাদের দীর্ঘদিনের ব্যবসা ও বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা থেকে এ দেশে এখন ইতিবাচক ব্যবসা ও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করেন। তারা বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগকে লাভজনক বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, নেদারল্যা-সের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক ক্ষেত্রসহ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নেও বাংলাদেশের একই ধরনের সাফল্য কামনা করেন এবং বাংলাদেশের সাথে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী এ সফরে নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রবাসী বাঙালিদের আয়োজিত একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও তাঁর যোগদানের কথা জানান।