460
Published on আগস্ট 8, 2015'জনগণের জন্য বেগম মুজিব তাঁর গোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি আমার মা কেবল এ জন্যই আমি একথা বলছি না। আমার বাবাকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তিনি আমার দাদা-দাদির পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন’ এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রাজনীতির অনেক কিছুই আমি এই মহান নারীর কাছ থেকে শিখেছি।'
আজ নগরীর ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবনের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা অর্জন এবং তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি। এই লক্ষ্য অর্জনে আমার মায়ের অনুপ্রেরণা অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে।’
'বঙ্গবন্ধু যখনই জেলে থেকেছেন, এ সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা নেপথ্যে থেকে দল গঠনে, মুজিবের রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য জনমত সৃষ্টিতে এবং আন্দোলন এগিয়ে নিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ভূমিকা পালন করেছেন, কখনো তিনি এজন্য কোন ধরনের প্রচারণা চাননি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সন্তান হিসেবে আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি।
নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সভাপতিত্ব করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন, বাংলা একাডেমরি মহাপরিচালক এবং বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক শামসুজ্জামান খান।
বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন, রেবেকা মোমেন, জাতীয় মহিলা সংস্থার সভাপতি মমতাজ বেগম এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি প্রমান্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, একজন নারী এবং স্ত্রী হিসেবে বঙ্গমাতার জীবনে কোন দাবি ছিল না এবং তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন জেলে বন্দী অন্যান্য নেতাদের পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট, সন্তাানদের পড়াশোনা এবং অসুস্থতায় তাদের পাশে থাকতেন।
দলের নেতা ও কর্মীরা কখনো তাঁর সহযোগিতা চাইলে বঙ্গমাতা কখনোই কাউকে ‘না’ বলেননি।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরিবারের কঠিন সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, যে সময় বঙ্গবন্ধু কয়েকজডন মামলার শিকার হন, তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয় এবং ১৯৫৪ সালে তাঁর পরিবারকে বাসভবন ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিনি আরো বলেন, এমনকি অনেক বাড়ির মালিক আমাদেরকে তাদের বাসা ভাড়া দিতে অস্বীকার করে।
তিনি বলেন, কিন্তু আমার মাকে আমরা ওই পরিস্থিতিতে কখনো চিন্তিত হতে দেখিনি এবং তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে সবকিছু মোকাবেলা করতেন এবং এমনকি তাঁর সন্তান ও দলীয় কর্মীদের খাবার যোগাতে তাঁকে ঘরের ব্যবহার্য জিনিস সামগ্রী বিক্রি করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মায়ের দৃঢ় মানসিকতা, মর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা।’ তিনি বলেন, বেগম মুজিবের কোন বিলাসী জীবনের আকাংখা ছিল না, এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন তখনও না।
শেখ হাসিনা বলেন, ওই সময়ে গোপালগঞ্জে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত কম থাকলেও বঙ্গমাতা শিক্ষার বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিয়মিত বিখ্যাত ইংরেজী লেখকদের বঙ্গানুবাদ পাঠ করতেন। এভাবেই বেগম মুজিব তাঁর প্রিয় বিশ্বখ্যাত ইংরেজি দার্শনিক বার্ট্রন্ড রাসেল সম্পর্কে জানেন এবং পরবর্তীতে তিনি তাঁর নামে নাম রাখেন তাঁর সর্বকনিষ্ঠ ছেলের।
ছয় দফা দাবির আন্দোলনে বঙ্গমাতার ভূমিকা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কঠোর গোয়েন্দা নজরদারীতে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তিনি (বেগম মুজিব) দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা বেগম মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং বঙ্গবন্ধুকে ছয় দফা দাবি থেকে সরে আসতে রাজী করাতে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে অনেক সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাও বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তাকে রাজী করানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতিবারেই বেগম মুজিব সাহসের সঙ্গে অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়েরের পর বঙ্গবন্ধু ছয় মাসের জন্য জেলে ছিলেন। ওই সময় তাঁর পরিবার তাঁকে ভাগ্যে কি ঘটছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিল। ছয় মাস পরে বঙ্গবন্ধুকে আদালতে নেয়া হয় এবং এ সময় পাকিস্তানী শাসকরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বৈঠকে অংশ নিতে প্যারোলে তাঁর মুক্তির ব্যাপারে বেগম মুজিবকে রাজী করতে চেষ্টা করে।
এ সময় শাসক গোষ্ঠী ও অনেক সিনিয়র দলীয় নেতা বেগম মুজিবকে সতর্ক করে যে, তিনি যদি তাদের আলোচনার শর্ত মানতে রাজী না হন তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি হতে পারে। কিন্তু বেগম মুজিব ওই মামলায় অভিযুক্ত অপর ৩৪ জনের ভাগ্যের কথা বিবেচনা করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে প্যারোলে নয় বঙ্গবন্ধু কেবল একজন মুক্ত মানুষ হিসেবেই ওই আলোচনায় অংশ নিতে পারেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল পাকিস্তানী শাসকরা বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, এর ফলে আইয়ুব খান ওই মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণদানের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাজী করতে বেগম মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মা তাকে অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং তিনি যা ভাল মনে করেন তাই উজ্জীবিত শ্রোতাদের সামনে বলার উপদেশ দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বেগম মুজিবের পরামর্শের কারণেই বঙ্গবন্ধু শ্রোতাদের সামনে ওই যুগান্তকারী ভাষণ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।