416
Published on এপ্রিল 15, 2015প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমালোচনা আমাদের সংশোধনে সহায়তা করবে। কিন্তু আমার প্রত্যাশা যে আপনারা এমন কিছু করবেন না, যা স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত শক্তিশালী করবে। এই বিরোধী শক্তি এ দেশের স্বাধীনতাই চায়নি।’
তিনি বুধবার গণভবনে বাংলা নববর্ষ-১৪২২ উপলক্ষে সম্পাদক, কলামিস্ট, লেখক ও টেলিভিশন টক-শো’তে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এলক্ষ্যে আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই এবং যা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, অবশ্যই আপনারা আমাদের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করবেন। তবে, তা যেন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে আমাদের বিরুদ্ধে বলার উপকরণ না জোগায়।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার জনগণের সেবা করতে ক্ষমতায় এসেছে- নিজের ভাগ্য গড়তে নয়। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বর্তমান সরকারের হাতে চলতি মেয়াদের মাত্র ৩ বছর ৯ মাস সময় আছে একথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সময় খুব অল্প, কিন্তু আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। ২০১৯ সালে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে সব উন্নয়ন কর্মসূচি একটি বিশেষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সৃষ্ট বহু বাধা মোকাবেলা করছে। ১৯৭৫ সালে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দেশ কার্যতঃ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং ২১ বছর জনগণকে দুঃসময়ের মধ্যে বাস করতে হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বিজয়ী জাতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যেতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছি। এজন্য যে কেউ যেকোন চ্যালেঞ্জ দিক্ না কেন, তা আমরা মোকাবেলা করবো এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবো।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচারসহ যেসব কাজ আমরা শুরু করেছি তা অবশ্যই শেষ করতে হবে। দু’টি রায় কার্যকর হয়েছে। আশা করি সব বাধা পেরিয়ে অন্যগুলোও সম্পন্ন করবো।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সেলিনা হোসেইন, দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সরোয়ার অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এতে স্বাগত বক্তৃতা দেন প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
সততাই তাঁর সরকারের মূল শক্তি একথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল পদ্মাসেতু ইস্যুতে আমাদের ভাবমূর্তি ম্লান করতে চেয়েছিল। আমরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব ব্যাংক পদ্মাসেতুর অর্থায়ন স্থগিত করেছিল। তারা ভেবেছিল যে ওদের অর্থ ছাড়া আমরা এ সেতু নির্মাণ করতে পারবো না। কিন্তু আমরা তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছি। পদ্মাসেতু হবে অসাধারণ এক স্থাপনা, এর জন্য বাংলাদেশের মানুষ গর্ববোধ করবে।
সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি মহল বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। তবে তারা ভুলে গেছে যে, মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ চালু করেন যা উপমহাদেশে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ১৯৯৩ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলা নববর্ষ ও শতাব্দীবরণ কেন্দ্রীয়ভাবে উদযাপন করতে তারা বাধা দিয়েছিল। এ উৎসবের সূচনা সম্পর্কে তাদের ধারণার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আমরা তখন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সরকারের সঙ্গে লড়াই করেছি।
‘পহেলা বৈশাখ আমাদের লোকজ সংস্কৃতি যা নিজ নিজ ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সকলকে সম্মিলন ঘটিয়েছে’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সকল ধর্মের লোকরা এ উৎসব উদযাপন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনে প্রতিবছর দেশব্যাপী আর্ট, সংস্কৃতি ও সাহিত্য গতিলাভ করে। সরকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সকল উপজেলায় প্রশাসনিক ও আর্থিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ধর্মীয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চায় বাধা দেয়ার কোন যুক্তি নেই।
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সকল স্তরের মানুষের অব্যাহত অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার পহেলা বৈশাকের কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে দেশের কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় কিনা- সেই উদ্বেগ আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে বেড়ায়।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যদি আমরা আর ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ না করি, তাহলে দেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে।
অতীতে জাতি এমন ধ্বংসযজ্ঞ ও ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেনি। এভাবে নিরীহ মানুষ প্রতিহিংসার শিকার হয়নি। আন্দোলনের নামে সাধারণ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা এবং আগুনে পোড়ানোর ঘটনা ঘটেনি।
গণমাধ্যমের বিষয়ে তাঁর সরকারের উদার নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে তাঁর সরকার ক্ষমতায় আসার পর টেলিভিশন চ্যানেল চালু, অনুমোদন ও প্রযুক্তি সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে এখাতের উন্নয়নে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে ৪১টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল চালু রয়েছে। সেখানে মেধাবী শিল্পী, কবি ও টেকনিশিয়ানরা চাকরি পেয়েছেন। এছাড়াও আমাদের আর্ট, সংস্কৃতি ও মিডিয়া সমৃদ্ধ হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সহজেই প্রযুক্তি সুবিধা গ্রহণ করে জনগণ যাতে তাদের জীবনযাত্রা সহজ করে তুলতে পারে সে জন্য তাঁর সরকার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষা সম্প্রসারণ ও মান উন্নয়নে সরকার ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশের জনগণ অবশ্যই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তবে প্রতি বিপ্লবী শক্তি ক্ষমতায় আসায় ৪৫ বছরেও আমরা স্বাধীনতার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারিনি।
প্রতি বিপ্লবী শক্তি সামরিক আইনের অধীনে দেশ শাসন করে এবং হাজার হাজার সাধারণ লোক মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। তারা ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধকে হত্যার পর কারফিউ জারি করে এবং এই কারফিউ ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
তিনি বলেন, প্রতি বিপ্লবীরা দেশকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীনতার আদর্শের বিপরীত দিকে নিয়ে যায় এবং ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও ঘৃণ্য অপরাধকারীরা জাতির অভিভাবক হয়ে ওঠে।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির প্রভাবের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের প্রভাব সর্বত্র এমনকি আন্তর্জাতিক ফোরামেও তাদের প্রভাব রয়েছে। এজন্য তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে।
ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায়, কতিপয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা করে বলেন, ‘এটা একটি জটিল দর্শন’ যে, তারা মানববাধিকার লংঘনকারীর পক্ষে কথা বলছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের মানবাধিকারের ব্যাপারে নীরব রয়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ নয়। তবে তারা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে চিৎকার করছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এ ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিদের আপনজনরা কিভাবে তাদের প্রিয় ব্যক্তিকে হারানোর জন্য ন্যায় বিচার পাবেন?
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের স্বচ্ছতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নির্বাচনী রেকর্ড রয়েছে যে, প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক নির্বাচনে ৪০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আরো উন্নয়নে সক্ষম হব। আমরা দেশের জন্য কাজ করতে ক্ষমতায় এসেছি, আমাদের নিজেদের জন্য নয়।
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল