তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে রাজ্য সরকার ভূমিকা রাখবে : মমতা ব্যানার্জী

642

Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2015
  • Details Image

মমতা ব্যানার্জী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি এবং দেশটির স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। এটি আমাদেরও দেশ, অতএব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে যথাশিগগির সম্ভব আমরা তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখব।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আজ বিকেলে এখানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকে একথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে দুই নেতা প্রায় আধা-ঘণ্টা একান্ত বৈঠক করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী আন্তরিক পরিবেশে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ ভারতের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে পরামর্শ দেন। মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থেই এই চুক্তি হবে।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরো বলেন, মমতা ব্যানার্জী সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। এটি ইতিবাচকই হবে।

মমতা ব্যানার্জী স্থলসীমানা চুক্তি (এলবিএ) সম্পর্কে বলেছেন, আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এই অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে। ইতোমধ্যেই বিলটি লোকসভায় পেশ করা হয়েছে। মমতা বলেন, যদিও বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার, তথাপি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখব।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি এবং লোকসভার আসন্ন অধিবেশনে বিলটি পাস করানোর জন্য আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। ফলে এ মুহূর্তে চুক্তি অনুমোদনে কোন বাধা নেই এবং লোকসভার আসন্ন অধিবেশনে এটি বাস্তবায়ন হবে।

এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অনেক আগেই স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুস্বাক্ষর করেছে এবং তিনি ছিটমহলবাসিদের দুর্ভোগের বিষয়টি স্মরণ করেন।

জবাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ছিটমহলবাসিদের দুর্ভোগের ব্যাপারে তিনি সচেতন আছেন, কেননা তিনি বিভিন্ন ছিটমহল পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, ‘সে কারণে আমাদের মধ্যে একটি মতৈক্য হয়েছে এবং আশা করি ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া লোকসভা অধিবেশনে এটি পাশ হবে।’

বৈঠক শেষে মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশের আমন্ত্রণে অমর একুশে কর্মসূচিতে যোগদান করতে পেরে তিনি আনন্দিত। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, তিনি এই আমন্ত্রণ খুবই গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক গঙ্গা ও যমুনা নদীর মতোই খুবই গভীর ও বিস্তৃত।

প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বড়বোনের মতোই দেখেন, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীও মমতা বন্দোপাধ্যায়কে তাঁর ছোট বোনের মতোই দেখেন’।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বয়সে ছোট ছিলেন এবং তিনি প্রায়ই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন।

অমর গান ‘শোনো একটি মুজিবরের কন্ঠে’ তাঁর প্রিয় গান এ কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি এ গানের কয়েকটি লাইন গেয়ে শুনিয়েছেন।

মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছেও মহান নেতা হিসেবে সম্মানিত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাথেও আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।’

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার ও বিস্তৃত করার প্রয়োজন রয়েছে।

তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব করতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি ভূমিকা রাখব’।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা বলেন, মমতা বন্দোপাধ্যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের অংশগ্রহণে যৌথ সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করতে একটি কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছেন। এই কমিটিতে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন। মমতা বন্দোপাধ্যায় কমিটির জন্য তার মন্ত্রিসভা থেকে একজন মন্ত্রীকে মনোনয়ন দেবেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের শিল্পীরা মেধাবী এবং তারা কলকাতায় খুবই জনপ্রিয়। বৈঠকে মমতা বন্দোপাধ্যায় ঢাকা হয়ে কলকাতা থেকে আগরতলা সরাসরি বাস সার্ভিস চালু করার প্রস্তাব দেন। বৈঠকে মমতা বন্দোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কলকাতায় বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে পশ্চিমবঙ্গ সফরের আমন্ত্রণ জানান। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে এ ভবনটি নির্মিত হবে।

মমতা বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার উদ্বোধনের জন্য কলকাতা সফরে যেতে শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান। মমতা বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় কবির নামে বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আমন্ত্রণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন দিকনির্দেশনা সংযুক্ত হয়েছে এবং এই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসবেন কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে আসার ভিত্তি স্থাপিত হলো মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এই সফরের মধ্যদিয়ে।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, আজকের আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর হৃদয়ে দুর্বলতা রয়েছে। তিনি তার মুখ্য সচিব ও অন্যান্যের পরিচয় করিয়ে দেন- যাদের শেকড় রয়েছে এ দেশে।

মমতা বন্দোপাধ্যায় সুস্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও রাজ্যের জনগণের কাছে পৃথক কোনো সত্ত্বা নয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের হৃদয়ে দুর্বলতা রয়েছে। দু’দেশের রাজনীতিবিদ, শিল্পী এবং জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের একজন মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন নেতা হিসেবে তিনি এবং তার দল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে ভূমিকা রাখবে।

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল ও চলচ্চিত্র সম্প্রচার সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল সম্প্রসারনে উদ্যোগ নেবে।

তিনি সম্পর্ক আরো জোরদারে যৌথ উদ্যোগের আরো চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, মমতা বন্দোপাধ্যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি শেখ হাসিনাকে উপহার দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নৌকার একটি ছবি উপহার দেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকার ছবি দেয়ার সময়ে প্রধানমন্ত্রী হেসে মমতাকে বলেন, নদীতে যেনো পানি থাকে। জবাবে মমতা বলেন, নদীতে পানির ব্যবস্থা করতে হবে।

ভারতের একজন সাংবাদিকের ইলিশ রফতানি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না, এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বিষয়টি মমতা হাসি-ঠাট্টার ছলে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা ইলিশ মাছ চাই। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পানি আসলে ইলিশ যাবে।

পরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের সম্মানে একটি ভোজসভার আয়োজন করেন।

ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত