510
Published on জানুয়ারি 17, 2015রকির বাড়ি উপজেলার শেখটোলা গ্রামে। অবরোধে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের ধরতে গত বৃহস্পতিবার ওই এলাকায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেদিন দুপুরে বাড়ির কাছে একটি আম বাগানে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেলে হামলার শিকার হয় রকি। গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে তাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রকি মারা যায়।
রামেক হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. জোবাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, রকির মাথার সামনে ও পেছনের অংশে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন আছে। আঘাতের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। শরীরের অন্যান্য অংশেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা রকির এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না। রামেক মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল শনিবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে যখন মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, তখন পুরো এলাকায় নামে শোকের ছায়া। সজল নয়নে, নত মস্তকে প্রতিবেশীরা ভিড় জমায় রুহুল আমিনের বাড়িতে। থমথমে মুখগুলো থেকে ঠিকরে পড়ছিল ক্ষোভের আগুন।
গতকাল সকাল ১১টার দিকে রকিদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, অন্তত শপাঁচেক লোক ভিড় করেছে। ঘরের বারান্দায় বিলাপ করছিলেন রকির মা নাজমা বেগম। শুক্রবার রাতে ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। মাঝেমধ্যে জ্ঞান ফিরলে শুধু বলছেন, 'আমার ব্যাটা অ্যাসেছে। আমি ওকে একবার দেখতে চাই। আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাও। আমাকে রেখে ও কই গেল?'
বাড়ির এক কোনায় বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন বাবা রুহুল আমিন। চিৎকার করে বলছিলেন, 'যারা আমার রকিকে খুন করল, তাদের আমি বিচার চাই। তাদের ফাঁসি চাই। ওই পশুরা কেন আমার ছেলেকে মারল, তারা কেন আমাকে মারল না?'
রুহুল আমিন জানান, আহত রকির সঙ্গে তিনি ও নাজমা রাজশাহী গিয়েছিলেন। কিন্তু রকির অবস্থা খারাপ দেখে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁদের দুজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এরপর থেকে ছেলের সুস্থতা কামনায় তাঁরা শুধু প্রার্থনা করে গেছেন। তবে কিছুতেই কিছু হলো না, চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল রকি।
রুহুল আমিন অভিযোগ করেন, সম্প্রতি রকিকে শিবগঞ্জের উজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। নিয়মিত স্কুলে যেত সে। বৃহস্পতিবারও স্কুলে গিয়েছিল। ওই দিন সকাল ১১টার দিকে শিবগঞ্জে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। অভিযান শেষ হওয়ার পর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে রকি। এরপর পাড়ার কয়েকজন ছেলের সঙ্গে খেলতে বের হয়। তারা গ্রামের একটি আমবাগানে গেলে জামায়াত-শিবিরের সাত-আটজনের একটি দল রকিকে ধরে ফেলে। তারা বাগানের ভেতরেই রকিকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা তাকে ফেলে চলে যায়। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে খবর দেয়। এরপর রকিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামের একাধিক ব্যক্তি নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে জানান, রকির ওপর হামলার ঘটনার আগে যৌথ বাহিনীর লোকজন ওই এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালায়। হামলাকারীরা হয়তো ধারণা করেছিল, রকি হয়তো যৌথ বাহিনীর সদস্যদের ওই বাড়িগুলো চিনিয়ে দিয়েছে। এ সন্দেহেই তার ওপর হামলা চালানো হয়।
রকির ভাই রুবেল হোসেন দাবি করেন, 'যৌথ বাহিনীর লোকজনকে সহায়তা করার সন্দেহে অথবা আমার বাবা আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় হয়তো রকির ওপর হামলা করেছে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। হামলার সময় যারা ছিল, রকি তাদের বেশির ভাগকেই চিনে ফেলেছে। মৃত্যুর আগে সে কয়েকজনের নামও বলে গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে বিপ্লব হোসেন, হাবিল উদ্দিন, পল্লব, জাহিদুল ইসলাম, আল-আমিনসহ আরো কয়েকজন। এরা সবাই স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে শিবগঞ্জ থানায়।
শিবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কারিবুল হক রাজিন বলেন, 'রকিকে নিমর্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের লোকজনই জড়িত। ২০১৩ সালেও তারা রকিদের বাড়িতে আগুন দিয়েছিল।'
শিবগঞ্জ থানার ওসি এম এম মইনুল ইসলাম বলেন, 'রকিকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টির সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এখনো মামলা হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নিতে মাঠে নামবে প্রশাসন।'