724
Published on নভেম্বর 1, 2014তিনি বলেন, সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে দেশের ৬৬টি উপজেলায় ৪ হাজার ২৭৫টি গ্রামে সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরো গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে দেশের সকল উপজেলায় এই কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হবে।
শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ৪৩তম জাতীয় সমবায় দিবস উদ্বোধনকালে বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে সমবায়ীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর নানা পণ্য উৎপাদন করছে।
তিনি বলেন, সমবায় বাজার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ন্যায্য দামে এসব পণ্য বিক্রি করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সমবায় বাজার নেটওয়ার্ক জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, এর ফলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং ভোক্তাদের কাছে ভেজালমুক্ত পণ্য পৌঁছা নিশ্চিত হবে।
অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা সমবায় ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ৯টি সমবায় সংগঠন ও একজন ব্যক্তির হাতে জাতীয় সমবায় পুরস্কার তুলে দেন।
এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এলজিআরডি ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব এম এ কাদের সরকার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
সমবায় অধিদফতরের রেজিস্ট্রার ও মহাপরিচালক এম মফিজুল ইসলাম স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের সভাপতি শেখ নাদিম হোসেন লিপু বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নের মূল ধারায় সমবায় আন্দোলনকে সমন্বিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সমবায়ের ইতিহাসে ১শ’ বছরের বেশি হলেও এই আন্দোলন বিভিন্ন পরীক্ষা, সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে।
এখন একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নের মূল ধারায় সমবায় আন্দোলনকে সম্পৃক্ত করার সময় এসেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সমবায় আন্দোলনকে কাজে লাগাতে চান।
তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা অন্যতম একটি হাতিয়ার হিসেবে একটি সমবায় আন্দোলনকে কাজে লাগাতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, একাজে বঙ্গবন্ধু সমবায়কে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে মালিকানার ২য় খাত হিসেবে সমবায়কে স্থান দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার নির্দেশ অনুযায়ী সারাদেশে সমবায়ভিত্তিক নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। গ্রামভিত্তিক কৃষি সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষকদের উচ্চফলনশীল বীজ, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি এবং গভীর নলকূপ সরবরাহের ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। পাশাপাশি জেলে, তাঁতী ইত্যাদি পেশাভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে সমবায়ের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির স্বপ্নকে হত্যা করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৯৬ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করি।
তিনি আরও বলেন, গৃহহীন ও আশ্রয়হীন মানুষের জন্য আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করি। এ প্রকল্পের আওতায় সমবায়ের মাধ্যমে শুধু তাঁদের বাসস্থানের ব্যবস্থাই করা হয়নি বরং তাঁদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে স্বল্প মূল্যে সার, বীজ এবং সেচের পানির ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম। দেশের প্রতিটি পেশার মানুষকে সমবায়ের পতাকাতলে আনার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামাত জোট সরকার আমাদের কর্মসূচিগুলো বন্ধ করে দেয়। সমবায়ীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিগৃহীত করার অপচেষ্টা করা হয়।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আমরা আবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর সমবায় খাতকে আবার শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে আমরা সমবায়কে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের প্রচেষ্টার ফলে দেশে বর্তমানে সমবায় সমিতির সদস্যের সংখ্যা প্রায় এক কোটি দুই লাখে উন্নীত হয়েছে। দেশের মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ আজ সমবায় সদস্য।
তিনি আরো বলেন, তাঁদের কার্যকর মূলধনের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। এ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে সমবায়ীরা ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা নীট মুনাফা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি ৪ লাখ ৮৪ হাজার সমবায়ীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা সমবায় আইনকে আরও যুগোপযোগী করে ২০১৩ সালে সংশোধিত সমবায় আইন প্রণয়ন করেছি। একইভাবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সমবায়ভিত্তিক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে সমবায় নীতিমালা ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশেও দুগ্ধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সমবায়ের সফল দৃষ্টান্ত রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শুধু দুগ্ধখাতে নয়, কৃষি ও অকৃষিজাত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন, মাছ, মাংস, শাক-সব্জি, হস্তজাত পণ্য, মৃৎশিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সমবায়ভিত্তিক উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, মূল্যসংযোজন ও বাজারজাত করার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি-ব্যবসায়ীদের মত শুধুমাত্র মুনাফামুখী না হওয়ায় উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা উভয়েই লাভবান হবেন। পৃথিবীর অনেক দেশই এ ধরণের সমবায় বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবসা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, এসব বিষয় বিবেচনা করে আমরা ইতোমধ্যেই সমবায় সমিতিগুলোর সমন্বয়ে বাজার কনসোর্টিয়াম তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সমবায় বাজার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এটা ব্যাপকভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি বাড়ী একটি খামার’ প্রকল্পের সুবিধাভোগীসহ পল্লী এলাকার অন্যান্য সমবায়ীদের ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য সম্প্রতি আমরা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন পাশ করেছি।
তিনি আরও বলেন, সমবায়ীরা তাঁদের সঞ্চিত অর্থ পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে রাখতে পারবেন এবং স্বল্প সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে নানা ধরনের উৎপাদন ও বিপণন কাজ পরিচালনা করতে পারবেন।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য কৃষকদেরকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। আমাদের সীমিত কৃষি জমির টেকসই ব্যবহার এবং চাহিদামাফিক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা উভয়কে স্বস্তি দেয়া।
তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামকে স্বয়ং-সম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। কৃষিজমির অপচয় বন্ধের জন্য গ্রামাঞ্চলেও বহুতলবিশিষ্ট ক্লাস্টার ভিলেজ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি গ্রামে অথবা পাশ্ববর্তী কয়েকটি গ্রাম মিলে এ ধরণের অবকাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। যেখানে স্কুল, বাজার, মসজিদ, মন্দির সবকিছু থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গণ-মানুষের সরকার। আমরা যখনই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাই, দেশের মানুষও তখন কিছু পায়। লক্ষ্য করে দেখেন, আমাদের বিগত দু-মেয়াদে দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল না। বরং দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে। গত বছর দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৬০ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। আমাদের আগের সরকারগুলো খাদ্য খয়রাতির জন্য বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিত।
তিনি বলেন, সব ধরণের নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আছে। মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ করেছি আমরা। পদ্মাসেতুর মত বৃহৎ প্রকল্প আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। ষোল কোটি মানুষের দেশে প্রায় ১২ কোটি মোবাইল সীম ব্যবহার হচ্ছে। মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, তবে, এ নিয়ে আত্মতুষ্ঠির কোন সুযোগ নেই। আমরা আরও সামনে এগিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে পথ চলা শুরু করেছে। আমাদের এ পথচলাকে আরও বেগবান করতে হবে। ২০২১ সালের আগেই আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম-আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। এ জন্য সবাইকে আন্তরিকতা ও নিষ্টার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আজকে যেসব সমবায় সমিতি এবং সমবায়ী জাতীয় সমবায় পুরস্কার-২০১২ গ্রহণ করছেন তাঁদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, আপনাদের কাছ থেকে অন্যান্য সমবায় সমিতি এবং সমবায়ীরা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হবেন।
-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল