2167
Published on সেপ্টেম্বর 18, 2014জাপান-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। জাপান বাংলাদেশের ১১তম বৃহত্তম রপ্তানী বাজার; তাদের বাংলাদেশ থেকে আমদানীর পরিমাণ স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে মোট আমদানীর ২৬% এবং দেশগুলোর মধ্যে কেবল কম্বোডিয়ার তুলনায় এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে জাপানের আমদানীকৃত পন্যগুলোর মধ্যে সচরাচর পন্যগুলোর মধ্যে চামড়াজাত পন্য, তৈরি পোশাক এবং চিংড়ী অন্যতম। জাপান বাংলাদেশে বহির্বিশ্বের সরাসরি বিনিয়োগের চতুর্থতম বৃহত্তম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম সারিতে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মালেশিয়া। জাপানের বাংলাদেশের সাথে দৃঢ় সম্পর্কে পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদের প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সমর্থন পাওয়া এবং তাদের ফিনিশড বা প্রস্তুত পন্যসমূহের বাজার নিশ্চিত করা। তাই, জাপান বাংলাদেশের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী উৎস।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, জাপান, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলা একটি বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী। আলাদা করে বললে, তারা সবসময়েই আমাদের সংকটময় খাতগুলোতে, যেমন দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জনশক্তি উন্নয়ন উদার সহায়তা দিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ERD)এর তথ্যমতে, জাপান এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে, যার মধ্যে ৩.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল অনুদান এবং ৪.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ হিসেবে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২২ ঘণ্টার এক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সভা শেষে তার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক যুগ্ম বিবৃতিতে উভয়েই জানান, ‘নিউক্লিয়ার শক্তির শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ব্যবহারে লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ মত-বিনিময়’ তারা নিয়মিতভাবেই চালাতে আগ্রহী। এ ধরনের মত-বিনিময়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিউক্লিয়ার শক্তির শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ব্যবহারে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির সামর্থ্য বৃদ্ধি। এর আরো লক্ষ্য ছিলো টোকিও ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানীর অধীন ফুকুশিমা দাইচি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনা থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা বিনিময় করা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে, একটি টেকসই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, এই কথাটা মাথায় রেখে দুই নেতাই স্বীকার করেন একটি শান্তিপূর্ণ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও অন্যান্য শক্তি উৎপাদনে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জাপানের বিগ-বি (Bengal Industrial Growth Belt (BIG-B)) উদ্যোগের, বাংলাদেশেকে নিয়ে জাপানের মহাপরিকল্পনা, অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এই ‘নিরব্চ্ছিন্ন টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা’। দুই প্রধানমন্ত্রীই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান এবং প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণী সভা আয়োজনের তাগিদ ব্যক্ত করেন।
জাপান তাদের বিগ-বি উদ্যোগের মাধ্যমে যে সহায়তা দিতে চায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পরিবহণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, টেকসই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, নগর উন্নয়ন যেমন অর্থনৈতিক জোন উন্নয়ন এবং প্রাইভেট সেক্টরে উন্নয়ন যেমন অর্থের যোগান দেয়া। যুগ্ম বিবৃতিতে এই উদ্যোগের তিনটি মূলস্তম্ভও উল্লেখ করা হয় যেগুলো হচ্ছে, অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি। উভয় নেতাই আশাপ্রকাশ করেছেন যে, জাপানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে, যেমন কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রভৃতির মাধ্যমে বিগ-বি উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে, উভয় দেশই পারস্পরিকভাবে উপকৃত ও সমৃদ্ধ হবে। উভয় নেতা সর্বাঙ্গীন সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের অঙ্গীকারে এই যুগ্ম বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪। বিবৃতি অনুযায়ী তারা, পারস্পরিক, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক এবং বহুপাক্ষিক বিভিন্ন সমস্যার পারস্পরিক আগ্রহসমূহে গভীর আলোচনা করেছেন।
আবে আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেবার অঙ্গীকার করেন, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবছর গত মে ২৫ থেকে ২৮, ২০১৪ এর সফরে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারও অন্তর্ভূক্ত এবং এর সবই এই বিগ-বি মহাপরিকল্পনার অংশবিশেষ বলে জানিয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলকে একীভূত করে এর ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখার এক মহা-রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উপসাগর, যার উত্তরে বাংলাদেশ অবস্থিত।
আবে বিগ-বি ধারণার তিনটি মাত্রা উল্লেখ করেন। একটি হচ্ছে, শিল্পোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন তুলে ধরা, দ্বিতীয় হচ্ছে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি এবং শেষেরটি হচ্ছে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে ‘সংহতি এবং একতা’-কে মূলমন্ত্র হিসেবে তুলে ধরা। বিশেষ করে, তিনি বলেন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো, নিরবচ্ছিন্ন ও টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক জোনসহ নগর উন্নয়ন এবং পাবলিক সেক্টরে বাজারে প্রবেশের সুব্যবস্থা সেই সাথে অর্থবাজারে সম্পৃক্তি এই বিগ-বি ধারণার প্রধান উপজীব্য। তিনি আরো আশা প্রকাশ করেন এই সব খাতে বাংলাদেশ উন্নত জাপানি কারিগরি জ্ঞান ও সুবিধা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করতে পারবে।
বিশ্ব-শান্তি ও স্থিতি অর্জনে পারস্পরিক সহযোগীতা, পারস্পরিক আগ্রহ ও আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক ও মানুষের পাস্পরিক বিনিময় এগুলোই ছিল অংশীদারিত্বের মূল। জাপান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও বাংলাদেশের সমর্থন চায়, যেখানে বাংলাদেশও অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। আগামি বছরের নির্বাচনে যার একটি নির্বাচিত হবে। যদিও আবে তার বক্তব্যে এর উল্লেখ করেননি, তবে জাপান বাংলাদেশের কাছ থেকে এটি বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ পেয়ে গিয়েছে। তাই, সার্বিকভাবেই আশা করা যাচ্ছে দুই দেশের পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুটো দেশই নিকট ভবিষ্যতে অনেক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যমান নথিপত্র বলছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) বাংলাদেশ অফিসটি ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয় এবং সে বছরই প্রথম জাপানি অফিসিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ODA) ঋণ দেয়া হয় বাংলাদেশকে। তারপর থেকে, জাপানের থেকে বাংলাদেশ প্রায় ১১.১৮ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন সহায়তার আশ্বাস পেয়েছে, যার মধ্যে ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার গত ২০১২-১৩ অর্থ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দিয়েছে। ২০১৩ সালে, উভয় সরকার ৩৩তম এবং ৩৪তম ওডিএ ঋণের জন্য স্বাক্ষর করেছে যার পরিমাণ ১.৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই প্যাকেজের আওতায় প্রধান প্রকল্পগুলো হলো: ক) ঢাকার দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প খ) জাতীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প গ) ভেড়ামারায় কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প ঘ) কাঁচপুর, মেঘনা এবং গোমতী ব্রিজের সংস্কার প্রকল্প ঙ) কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্ব) চ) উত্তরবঙ্গে সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প ছ) নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন প্রকল্প। ৩৫তম ওডিএ ঋণ প্যাকেজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং খুব শিঘ্রই স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মে ২৭, ২০১৪, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (JETRO)এর হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসার সুযোগ সংক্রান্ত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। সেই ফোরামে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং অথোরিটি (BEPZA) এবং JETRO, বাংলাদেশে একটি বিশেষ শিল্প পার্ক স্থাপনের বিষয়ে সমঝোতার স্মারকে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ বিভিন্ন ইপিজেডএ ৪০টি শিল্প প্লট জাপানি উদ্যোক্তাদের দিতে চেয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে, বাংলাদেশ ঈশ্বরদী, মংলা এবং উত্তরা ইপিজেডে শিল্প প্লট বরাদ্দ রাখবে জাপানি উদ্যোক্তাদের জন্য। জাপানি উদ্যোক্তাগণ আদমজী ও কুমিল্লা ইপিজেডে ফ্যাক্টরি বিল্ডিং বরাদ্দ পাবে যেখানে বর্তমানে কোনো প্লট খালি নেই। এসবের ফলে জাপানি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আরো বলিষ্ঠ হবার পথ পাবে, যেহেতু জাপান থেকে আরো ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব বেশ কিছু সময় ধরে অপেক্ষমাণ আছে বাংলাদেশের বোর্ড অফ ইনভেস্টমেন্ট (BoI) এর কাছে, কিন্তু তার সফলতার জন্য আভ্যন্তরীন বিনিয়োগ পরিবেশ এবং দেশের আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
-Financial Express