948
Published on সেপ্টেম্বর 17, 2014আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন।
বিলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ৭২ এর সংবিধান অনুযায়ি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার বিধান পুন:প্রবর্তন করা হয়েছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বিলটি উত্থাপন করে পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে রিপোট প্রদানের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্থায়ী কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। রিপোর্টে উত্থাপিত বিলটির প্রস্তাবনা, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের বিভিন্ন দফায় এবং বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে সংশোধনী আনা হয় । আর আজ স্থায়ী কমিটির সুপারিশ অনুযায়ি বিলটি বিভক্তি ভোটে পাস করা হয়।
বিলে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা (২), (৩), (৪), (৫), (৬), (৭), ও (৮) এর পরিবর্তে দফা (২), (৩), ও (৪) প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ তিন দফায় বলা হয়েছে, (২) প্রমাণিত অসদাচণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যুন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাবে ন। (৩) এ অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। (৪) কোন বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করতে পারবেন।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা, ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদ এর বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং তাদের পক্ষে এ ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এর প্রতিফলনে ১৯৭২ সনে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে তার বিরুদ্ধে প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে অপসারণের বিধান ছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে এই পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থের কারণে রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা কোন বিচারককে তার পদ থেকে অপসারিত করা যাবে বলে বিধান করা হয়। উক্ত বিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, কোন বিচারককে তার সম্পর্কে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর যুক্তিসঙ্গত সুযোগদান না করা পর্যন্ত তাকে অপসারিত করা যাবে না।
১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সনের সামরিক ফরমান দ্বারা সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থের অভিযোগে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অপর দুইজন প্রবীণ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সংসদে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার নীতি বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে সংবিধানের বিদ্যমান ৯৬ অনুচ্ছেদ এর দফা ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ পরিবর্তে ১৯৭২ সনে প্রণীত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা ২, ৩ ও ৪ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদ সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) আইন, ২০১৪ এর বিল উত্থাপন করা হয়েছে।
উক্ত বিলের ৩ দফার বিধান অনুযায়ী কোন বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সুতরাং উক্ত আইনে সুনির্দিষ্টকৃত পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের কোন বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকবে না। এমতাবস্থায় বিলটি আইনে পরিণত হলে স্বচ্ছতা দৃশ্যমান হবে এবং স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে, বিচারকগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অবাধ ও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রতিপালনের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সমুন্নত রাখতে পারবেন।
সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জিয়া উদ্দীন আহমেদ (বাবলু) কাজী ফিরোজ রশীদ, এমএ হান্নান, মো. ইয়াহিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মিলন, পীর ফজলুর রহমান, রওশন আরা মান্নান, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, নাজমুল হক প্রধান, শিরীন আখতার, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদসা, মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, শেখ হাফিজুর রহমান, ইয়াসিন আলী, স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজী, হাজী মো. সেলিম, তাহজিব আলম সিদ্দিকী, মো. আব্দুল মতিন ও বি এন এফ এর আবুল কালাম আজাদ বিলের ওপর জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাব আনেন।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক প্রস্তাবগুলোর ওপর বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ৭২ এর সংবিধান পুন:প্রবর্তন ও বিচার বিভাগের মর্যদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংসদের হাতে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা প্রদানের বিধান করে সংবিধানের এ সংশোধন বিল পাস করা হচ্ছে। তিনি বিলের বিষয়ে সংসদের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় টক শোতে আলোচনার জবাব দেন। আলোচকদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, দশম জাতীয় সংসদের সংবিধান সংশোধন করার বিষযে অবশ্যই বৈধতা রয়েছে। আর এ সংসদ যে বৈধ তার একশ’ কারণ উল্লেখ করা যাবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে বিচারপতিদের অপসারণ সংসদের হাতে ন্যস্ত রয়েছে।
পরে তিনি সংসদ সদস্যদের আনীত বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাবের জবাব দেন। তিনি বলেন, ’৭২ এর সংবিধানে এ সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে এ সংশোধনী বিলে হুবুহু রাখা হয়েছে। পরে সংসদ সদস্যদের আনীত সংশোধন প্রস্তাবগুলো কন্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সংসদের অনুমোদন নিয়ে বিলের সবগুলো দফা একত্রে বিভক্তি ভোটে দেয়া হয়। রাত দশটা ১৫ মিনিটে বিভক্তি ভোটের ঘন্টা বাজানো শুরু করে ১০টা ১৭ মিনিটে শেষ করা হয়। এর পর নিয়ম অনুযায়ি স্পিকার বিলের প্রস্তাবনা ও শিরোনাম ভোটে দেন এবং পরে স্পিকার সংসদ সদস্যদের বিভক্তি ভোটে অংশ নিতে অনুরোধ জানান। বিভক্তি ভোটে হ্যাঁ ভোটের জন্য সংসদের ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর লবি নির্ধারণ করা হয়। আর ১ নং লবি না ভোটের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
রাত ১০টা ১৮ মিনিটে শুরু হয়ে ১০টা ৪৩ মিনিটে বিভক্তি ভোট শেষ হয়।
এর পর ১০টা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। ফলাফলে হ্যাঁ পক্ষে ৩২৮টি ভোট এবং না পক্ষে কোন ভোট পড়েনি। এর মাধ্যমে বিলের প্রস্তাবনা ও শিরোনাম সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়।
পরে আইনমন্ত্রী স্থায়ী কমিটির সুপারিশকৃত আকারে বিলেটি পাসের প্রস্তাব করলে পুনরায় বিভক্তি ভোটে দেয়া হয়। এ পর্যায়ের বিভক্তি ভোট ১০টা ৫০ মিনিটে শুরু হয়ে ১১ টা ০৬ মিনিটে শেষ হলে স্পিকার ফলাফল ঘোষণা করেন। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ি হ্যাঁ পক্ষে ৩২৭টি ভোট পড়ে এবং না পক্ষে একটি ভোটও পড়ে নি। ফলে সর্বসম্মভাবে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল পাস হয়।
-বাসস