416
Published on সেপ্টেম্বর 2, 2014তিনি বলেন, ‘বিশ্ব আজ যে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসী হুমকির সম্মুখীন, তা কোন দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এদেরকে মোকাবেলার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে একে অন্যের সাথে সহযোগিতা ও সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে হোটেল রেডিসনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গোয়েন্দা প্রধানদের ৭ম সম্মেলন (এপিআইসিসি) উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।
পাঁচদিনের এ সম্মেলনে ২৭টি দেশের গোয়েন্দা প্রধানগণ অংশ নিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসীরা তাদের টিকে থাকার জন্য সবসময়ই উদ্ভাবনী শক্তিতে খুবই তৎপর। যখনই তাদের কোন একটা কর্মকৌশল উদঘাটিত হয়, সাথে সাথে তারা নতুন কৌশলের উদ্ভাবন ঘটায়। সুতরাং এটি সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জিং মিশন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিজ (ডিআইএ)’এর পরিচালক ডগলাস এইচ ওয়াইজ এবং ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স (ডিজিএফআই) ’এর ডাইরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল আকবর হোসেন বক্তব্য রাখেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, তিনবাহিনী প্রধানগণ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ড এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর যৌথভাবে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গোয়েন্দা প্রধানদের ৭ম সম্মেলন আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশে দেশে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে।
তিনি বলেন, এসব জঙ্গিগোষ্ঠী সাধারণ মানুষের জানমালের পাশাপাশি বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বশান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর মোকাবেলা আজ শান্তিকামী জনগণের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
শেখ হাসিনা বলেন, ভয়াবহ রক্তপাতের মধ্যদিয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের জনগণ সব সময়ই শান্তির পক্ষে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস নীতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেন, এ জন্য স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য যে পররাষ্ট্র নীতি ঘোষণা করেছিলেন তার মূল বক্তব্য ছিল ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এই নীতির আলোকেই পথ চলছে।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইতিহাসের নির্মমতম হত্যাকান্ডের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর পরিবার বার বার ভয়ানক সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয়েছে।
তিনি বলেন, তাঁর উপর সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মধ্যে ভয়াবহতম ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। এ হামলায় আমাদের দলের নেতা আইভী রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী শহীদ হন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আজ দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই কোন ধরণের হুমকিই আমাকে সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নেয়া অবস্থান থেকে সরাতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আমার বক্তৃতায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম তাতে আমি আমৃত্যু অবিচল থাকবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা, দেখা গেছে জঙ্গিবাদ বিস্তারের পেছনে অনেক রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে তাঁর সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সকল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তিনামা ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সক্রিয় অংশীদার।
তিনি বলেন, এসবের পাশাপাশি, দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেরায় প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে ধর্মীয় শিক্ষা আধুনিকায়নের জন্য শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে সরকার জাতীয় সন্ত্রাস বিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। এ বছর বাংলাদেশ আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনে পালার্মো কনভেনশনের সাথে যুক্ত হয়।
সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ বিস্তারে অর্থের যোগান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীদের হাতে যাতে অর্থ যেতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইন এবং কনভেনশনের সাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে।
এ ব্যাপারে তিনি অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসীদের অর্থের যোগান বন্ধে ২০১২ সালে সুনির্দিষ্ট শর্ত সম্বলিত অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন পাশ করার কথা উল্লেখ করেন।
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ অর্থপাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ও অন্যান্য আর্থিক অপরাধ বন্ধে ১৩১ সদস্য বিশিষ্ট এগমন্ড গ্রুপের সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অর্থপাচার সংক্রান্ত ৪১ সদস্য বিশিষ্ট এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আন্তর্জাতিক গ্রুপেরও সদস্য হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচার এবং সন্ত্রাসবাদে অর্থ যোগান বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ২০১৩ সালে ১৩১-রাষ্ট্র বিশিষ্ট এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হয়েছে। এছাড়া, অর্থপাচার সংক্রান্ত ৪১-সদস্য-বিশিষ্ট এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় আন্তর্জাতিক গ্রুপেরও সদস্য হয়েছে।
তিনি বলেন, অর্থপাচার সংক্রান্ত এসব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দিয়েছে। এছাড়া, সন্ত্রাস এবং অপরাধ প্রতিরোধ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে আলাদা আলাদাভাবে দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। পাশাপাশি সার্ক দেশসমূহের উদ্যোগে আমরা সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তি বাস্তবায়ন করে চলেছি।
‘বাংলাদেশের মাটিকে যাতে কোন বিদেশী উগ্রবাদীর চারণভূমি হতে না পারে, সেজন্য আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। সেজন্য আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি যোগান দিয়ে চলেছি। সেই সাথে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে যেন মানবাধিকার অক্ষুণœ থাকে তার জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি।
তিনি বলেন, আমি সবসময়ই একটা কথা বলে থাকি- সন্ত্রাসীদের কোন নির্দিষ্ট সীমানা নেই। এরা দেশের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু, বিশ্ব মানবতার শত্রু। এরা বিশ্বশান্তির পথে অন্তরায়। আপনাদের গোয়েন্দা কাজের অন্যতম উদ্দেশ্য হল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো পূর্বে বিচ্ছিন্নভাবে এবং সমন্বয়হীনভাবে কাজ করলেও আজ প্রযুক্তির বদৌলতে তারা আরও বেশী সুসংহত ও সমন্বিতভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, তাদের চলাচলের গতি বেড়েছে; যোগাযোগ সহজ হয়েছে এবং আত্মগোপনের জন্য তারা বিস্তীর্ণ এলাকা ব্যবহার করছে। বিশ্ব আজ যে বহুমাত্রিক সন্ত্রাসী হুমকির সম্মূখীন, তা কোন দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এদেরকে মোকাবিলার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে একে অন্যের সাথে সহযোগিতা ও সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্যমান দেয়ালগুলো ভেঙ্গে যাবে। আপনাদের মধ্যে দূরত্ব কমে যাবে এবং বোঝাপড়া বৃদ্ধি পাবে। মনে রাখবেন, সন্ত্রাসীরা তাদের টিকে থাকার জন্য সর্বদাই উদ্ভাবনী শক্তিতে খুবই তৎপর। যখনই তাদের কোন একটা কর্মকৌশল উদ্ঘাটিত হয়, সাথে সাথে তারা নুতন কৌশলের উদ্ভাবন ঘটায়। কাজেই আপনাদের মিশন সত্যিই চ্যালেঞ্জিং।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের এ ব্যাপারে সর্বদা সজাগ থাকার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের সফলতার উপর নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা ও সফলতা। এই সম্মেলনের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য "দি ফিউচারঃ চ্যালেঞ্জেস এন্ড অপরচুনিটিস ফর সিকিউরিটি কো-অপারেশন" অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, ভবিষ্যত যুদ্ধকৌশল, সাইবার নিরাপত্তা এবং বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আপনারা মতবিনিময় করবেন। বিশ্বশান্তি বিনষ্টকারী এসব হুমকি মোকাবেলায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
-বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা
ছবিঃ সাইফুল ইসলাম কল্লোল