বাংলাদেশে ক্যান্সার চিকিৎসার নব দিগন্তের সূচনা হলো : প্রধানমন্ত্রী

969

Published on এপ্রিল 9, 2014
  • Details Image


প্রধানমন্ত্রী জনগণের অর্থে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠানকে জনগণের সেবায় উৎসর্গ করার জন্য আহছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানান।
তিনি আরো বলেন, আমি আশা করবো, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ক্যান্সার রোগীরা যাতে অতি সহজে এবং কম খরচে এখানে চিকিৎসার সুযোগ পায় সেদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে রাজধানীর উত্তরায় আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার এন্ড জেনারেল হাসপাতালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, সাবেক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং ঢাকা আহছানিয়া মিশনের উপদেষ্টা ও আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার এ্যাণ্ড জেনারেল হাসপাতালের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রফিকুল হক।
আহছানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন মিশনের উপদেষ্টা সৈয়দা দীনা হক।
শেখ হাসিনা বলেন, ক্যান্সার ও সাধারণ- উভয় প্রকার রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে আগামীতেও এ হাসপাতালের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অতীতের মত সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রতিষ্ঠানটিকে ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি অত্যাধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, ‘আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে জনগণের কল্যাণে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সবাই একত্রে কাজ করি, তাহলেই বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু হবে’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,’ ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন কর্তৃপক্ষ জনগণের অর্থে এ ধরনের একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করতে যাঁরা অকুণ্ঠচিত্তে অর্থ সাহায্য দিয়েছেন আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবন-জীবিকা, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিশন দ্বারা নির্মিত দেশের বৃহত্তম এই ক্যান্সার হাসপাতাল, ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বিশাল সুযোগ তৈরি করেছে’।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি জেনে খুশি হয়েছি যে, সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলায় ৬ থেকে ৮ বছর বয়সী ভাসমান শিশুদের নিয়ে ‘আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরী’ গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে পর্যায়ক্রমে ১০ হাজার পথশিশু মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় সুযোগ পাবে।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সরকার সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে আমাদের এসব কার্যক্রম জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। এমডিজি পুরস্কার, সাউথ-সাউথ এ্যাওয়ার্ডসহ আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি। তিনি স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সফলতা ধরে রাখতে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করায় বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
তিনি বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও বিশ্বের দুর্নীতি পরায়ন দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা এবং মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে’।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নেও আমাদের অর্জন লক্ষণীয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০১০ সালের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সরকার ১৫ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। ১৩ হাজার ৫০০ জন কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রভাইডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকার কুর্মিটোলা ও খিলগাঁয়ের মুগদায় ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল, ফুলবাড়িয়ায় সরকারি কর্মচারি হাসপাতাল, আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এন্ড হাসপাতাল নির্মাণ করেছি। সাভারে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা ৫টি নতুন মেডিক্যাল কলেজ, ৬টি ডেন্টাল কলেজ, ৫টি হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, ৭টি নার্সিং কলেজ ও ১২টি নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের সরকারের গত মেয়াদে ৫ হাজারেরও বেশি এডহক চিকিৎসকের চাকুরি স্থায়ী করা হয়। এডহক ও বিসিএস এর মাধ্যমে ৫ হাজার ৭৪৩ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২ হাজার ২৮৩ জন চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১ হাজার ৯৫৮টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নার্সদের পদমর্যাদা ৩য় শ্রেণী থেকে ২য় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারির বিভিন্ন পদে ১৭ হাজার কর্মচারিসহ প্রায় ৭৫ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একটি যুগোপযোগী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করেছি। চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করায় শিশু মৃত্যুহার ৬৫ থেকে ৩৬-এ নেমে এসেছে। মাতৃ মৃত্যুহারও যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। যক্ষা, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যানথ্রাক্স, নিপাহ্, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে আমরা যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছি।
তিনি বলেন, কালাজ্বরে মৃতের সংখ্যা এখন শূন্যে নেমে এসেছে। পোলিও রোগ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়েছে। ক্যান্সার, হৃদরোগসহ অসংক্রামক রোগের উন্নত চিকিৎসা, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কারণে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৬৮ বছর হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সকল জেলা এবং উপজেলা হাসপাতালে মোবাইল ফোনে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারকে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। তাই সকল উপজেলা হেল্থ কমপ্লেক্সে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের পাশাপাশি ওয়েব ক্যাম সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানুষ যাতে চিকিৎসাসেবা পায় তার ব্যবস্থা আমরা করেছি। তৃণমূল পর্যায়ের সাধারণ মানুষ যাতে সহজে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পায়, সে বিষয়টিও সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে মোবাইল সীম গ্রাহকের সংখ্যা ১১ কোটি ৬ লাখ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মোবাইলে থ্রি-জি চালু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত পাঁচ বৎসরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। গত ৩০ মার্চ রেকর্ড ৭ হাজার ৫৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ১০৪৪ মার্কিন ডলার। দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। এক কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রায় ৫ কোটি মানুষ দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে, আর ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হবে।
পরে প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের উদ্বোধন ঘোষণা করেন এবং মুনাজাত অনুষ্ঠানে অংশ নেন। উদ্বোধনের পর শেখ হাসিনা হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখেন।
অনুষ্ঠানে হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য ডাচ বাংলা ব্যাংক ১৫ কোটি টাকা ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১০ লাখ টাকার চেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেন।
তুরাগ নদীর তীরে ৬.৫ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ১৫ তলা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন ১৯৯৭ সালের আওয়ামী লীগ সরকার হাসপাতালের জন্য এ জমি বরাদ্দ দেয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, ৪.৫ লক্ষ বর্গফুট স্পেসের এ হাসপাতালটির কাজ তিন ধাপে শেষ হবে। প্রথম ধাপের কাজ শেষ করে আজ থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান শুরু করা হয়েছে। ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালের দ্বিতীয় ধাপের কাজ শেষ হবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এবং তৃতীয় ধাপের কাজ শেষ হবে ডিসেম্বরে।
কর্তৃপক্ষ জানান, প্রাথমিকভাবে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য আনুমানিক ব্যয় ২৫৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান হিসেব অনুযায়ী মোট ব্যয় হবে ৩৭৮ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তি অনুদানের সাহায্যসহ মোট ১১২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে সমাজকল্যাণ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান রয়েছে ৬৪ কোটি টাকা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, ‘নো লাভ নো ক্ষতি’ ভিত্তিতে হাসপাতালটি পরিচালিত হবে। দরিদ্রদের ৩০% ছাড়ে ও অতি দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।
হাসপাতালের বিভিন্ন চিকিৎসা ও পরিষেবার ব্যয়ে আগ্রহী দাতাগণ নিজের নামে বা প্রিয়জনের নামে তা চালু করতে পারবেন, এমন বিধান রাখা হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের অন্যান্য শীর্ষ হাসপাতাল থেকে এখানে চিকিৎসা ব্যয় কম হবে।
কর্তৃপক্ষ জানান, দরিদ্ররা যেন বিনামূল্যে বা ভর্তুকি দিয়ে চিকিৎসা সেবা পেতে পারে এ জন্য আহছানিয়া মিশন ইতোমধ্যে একটি তহবিল গঠন করেছে। ১০০ কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মূদ্রার বছরব্যাপী সংরক্ষিত এ তহবিল থেকে বর্হিবিভাগের চিকিৎসার জন্য ১.৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।

TAGS:

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত