929
Published on জুলাই 31, 2022গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রথমেই একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে হাত দেন বঙ্গবন্ধু। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে তিনি পুরনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে নতুন একটি ব্যবস্থার দিকে যেতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন, বাংলাদেশ হবে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সবার মানবাধিকার নিশ্চিত করা হবে। শুধু ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে নাক-কা-ওয়াস্তে ছদ্মবেশী কোনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাননি তিনি। তিনি চেয়েছিলেন সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে, যার ফলে সমাজের প্রান্তিক মানুষটিও স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কাছে গণতন্ত্রের অর্থ হলো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, ৮০ শতাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিক্ত মানুষের মানবাধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা। এজন্য হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বহু ধর্ম-বর্ণের এই জাতিকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধলেন তিনি। রাষ্ট্রের অন্যতম একটি মূল নীতি হিসেবে ঘোষণা করলেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাও তিনি সেসময় দিয়েছেন। এটি নিয়ে ভ্রান্তি ছড়ানোর কোনো অবকাশ নেই।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের ভাষণে এই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, ভ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি শুধু এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। পঁচিশ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বঙ্গবন্ধু নিজে তরুণ বয়সে কিন্তু একসময় শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দীদের সঙ্গে পাকিস্তান চেয়েছেন। এমনকি পাকিস্তান চেয়ে যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের মধ্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ধর্মকে পাকিস্তানিরা যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা বুঝতে পেরে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এবং সেই তখন থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য কাজ শুরু করেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু মেনিফেস্টো থাকবে।'
কিন্তু পাকিস্তানিরা যখন উর্দুকে ইসলামি ভাষা বলে চাপিয়ে দিতে চাইলো আমাদের ওপর, ১৯৪৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এই ঘোষণা দিলেন, তখন নিজে কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এর প্রতিবাদ করেন তরুণ শেখ মুজিব। পরবর্তীতে জেলে থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন, 'দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে। তুরস্কের লোকেরা তুর্কি বলে। ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে। মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে। চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।'
পাকিস্তান পর্বে যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবেদের বিকাশ ঘটে তার মধ্যে অন্যতম হলো: বৈষম্য ও শোষণমুক্তি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠান জন্য সংগ্রাম এবং অসাম্প্রদায়িকতা। যে কারণে, ১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় হয় এবং ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ 'আওয়ামী লীগ'-এ রূপান্তরিত হয়। এর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন এই দলটি। ষাটের দশকে এই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ আরো তীব্র হয়ে ওঠে ছয় দফার মধ্য দিয়ে। এর মূল দাবি ছিল মূলত সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বশাসনের। কিন্তু এর ভাবাদর্শগত ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার শেকড় অসাম্প্রদায়িকতার মধ্যে প্রোথিত। তৎকালীন সময়ে 'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা', 'জাগো জাগো, বাঙালি জাগো', 'জয় বাংলা'... এসব শুধু স্লোগান ছিল না। এসব মন্ত্রের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির মানসলোকে অসাম্প্রদায়িকতার বন্ধন রচিত হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী এক মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালে জন্ম শেখ মুজিবুর রহমানের। এরপর বেড়ে উঠেছেন নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। মূলত কিশেোর বয়স থেকেই তিনি প্রভাবিত হন তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা। নিজের ছোটবেলার ব্যাপারে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হতো মাদারীপুরে সুভাষ বোসের দলই শক্তিশালী ছিল।' সেই সময়টাতেই ইংরেজদের প্রতি বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় কিশোর শেখ মুজিবের মনে। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি ভেবেছেন, 'ইংরেজদের এদেশে থাকার কোনো অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে।'
বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা জীবনী থেকে আরো জানা যায়, ১৯৩৭ সালে তাকে পড়াতেন হামিদ মাস্টার নামের একজন, যিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা। আবার মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন বেশ সুপরিচিত। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের কারণে জেলও খাটেন। তাকে নিয়ে 'পূর্ণ-অভিনন্দন' নামে একটি কবিতা লিখে পাঠান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
হিন্দু-মুসলিম বিভেদ নয়, বরং একসঙ্গে মিলেমিশে অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এই শিক্ষা তিনি কৈশোরের এসব ঘটনা থেকেই পেয়েছেন। প্রথমে স্বদেশী আন্দোলন ও পরে সুভাষ বোসের প্রতি টানের কারণেই জীবনের শুরু থেকেই সাম্প্রদায়িকতা পরিত্যাগ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাই তার মানসপটে ধীরে ধীরে লেখা হচ্ছিলো মনুষ্যত্বের জয়গান।
পরবর্তীতে, ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জে যান, তখন শেখ মুজিবকে মুসলিম ছাত্রলীগের যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিব নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলে থাকার সময় পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এরপরও ধর্মীয় গোঁড়ামি বা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা তাকে কখনোই গ্রাস করেনি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। কাছে থেকে দেখেছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বর্বরতা, মানুষের আহাজারি। ছুটে গিয়েছেন আর্ত মানবতার সেবায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ যখন ইংরেজদের কারণে ক্রমেই নষ্ট হওয়ার মুখে, তখনও অনেকে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এটি টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু ইংরেজদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতির কারণে তা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তানিরাও ধর্মের ঢাল ব্যবহারের চেষ্টা করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্ব এবং তার প্রতি বাংলার মানুষের আস্থার কারণে পাকিস্তানিদের ধর্মের ট্রাম্পকার্ড ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসের মহাসড়কে মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, কালের আবর্তনে ধীরে ধীরে তিনিই হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক ও বাহক। এজন্য বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করতে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রধান এবং প্রথম শর্তও ছিল এটি।
বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝায়- অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার রোধ ও ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা। এক কথায়: ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। যাতে সবধরণের সাম্প্রদায়িক উস্কানির নাশকতা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, রক্তপাত থেকে রাষ্ট্র ও মানুষ নিরাপদ থাকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠতে পারে অনাবিল মুক্তির স্বাদ নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এক যুগের বেশি সময় ধরে ঠিক সেই প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণে বঙ্গবন্ধুর অহিংসা ও শান্তির দর্শন যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে অচিরেই উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লেখাবে বাংলাদেশ। গ্রামের একেবারের প্রান্তিক অসহায় মানুষটির কাছেও পৌঁছে যাবে উন্নয়নের সুফল।