6200
Published on জুন 15, 2021বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেছিল। নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহ করে সহযোগিতা করেছে, স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে এবং লাখ লাখ মা-বোন নির্যাতনের শিকার হয়ে বিজয়ে অবদান রেখেছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকেই স্বপ্নের সাথী হয়েছেন বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। একটি স্বাধীন দেশের জন্মের পেছনে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে যে নামটি উচ্চারিত হয়, তা হচ্ছে ফজিলাতুননেছা মুজিব। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কাজের প্রেরণার উৎস। তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে নিয়মিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন। একারণেই বঙ্গবন্ধু নারী মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ আওয়ামী সরকার প্রণীত ১৯৭২-এর সংবিধান। সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার দিকে বিশেষ করে নজর দেওয়া হয়। আর এই সংবিধানের ওপর ভিত্তি করেই নারীর ক্ষমতায়নের নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
১৯৭২ সালে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭-এ বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ অনুচ্ছেদ ২৮ এ আছে- ১. ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ ২. ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
সমাজে নারীর অংশগ্রহণ এবং সুযোগ বাড়ানোর জন্য ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ১০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করেন। নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশের জন্য সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদের আসন সংরক্ষিত করা হয়। এবং প্রথম সংসদে ১৫ জন নারীকে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য করা হয়। সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকলেও ৬৫(২) অনুচ্ছেদের অধীনে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত ৩০০ আসনেও নারীর অংশগ্রহণে সমান সুযোগ রয়েছে।
যুদ্ধের পর সামাজিকভাবে সংকটে পড়া নারীদের সম্মানিত করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে তিনি তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দেন।
বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের বিষয়টি প্রাধান্য দেন। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ও সমাজকল্যাণমূলক কিছু কর্মসূচি গৃহীত হয়। শহীদের স্ত্রী ও কন্যাদের জন্য চাকরি, ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত নারীর গর্ভে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হলো। তাদের পরিচয় দেওয়ার মতো কোনো কিছু ছিল না। সমাজ গ্রহণ করতে চাইল না। তাই নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালেই ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। তার নির্দেশে দিনরাত পরিশ্রম করে খুঁজে খুঁজে বের করে নির্যাতনের শিকার নারীদের তালিকা করা হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কাজের এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সরকার। অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, অ্যাডভোকেট মমতাজ বেগমের মতো তৎকালীন ১১ জন প্রখ্যাত শিক্ষক-নারী নেত্রী ও রাজনৈতিক কর্মী ওই বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
এদিকে যুদ্ধশিশুদের গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ। মায়েদের পক্ষে সম্ভব ছিল না শিশুদের লালন-পালনের ব্যবস্থা করা। তাই, বিদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা করা হয়। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেওয়া হয়। তবে দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জাতির পিতা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ভেবেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি মন্ত্রিসভায় দুজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তারা ছিলেন- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে অধ্যক্ষ বদরুন্নেসা আহমেদ এবং সমাজকল্যাণে বেগম নূরজাহান মুরশিদ।
১৯৭৪ সালে নারী উন্নয়ন বোর্ডকে পুনর্গঠন করে সংসদে অ্যাক্টের মাধ্যমে নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে রূপান্তর করা হয়। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথটি তৈরি হয়। এই সময় নারী উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. জেলা ও থানা পর্যায়ে ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা। ২. বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত করা। ৩. নারীকে উৎপাদনমুখী কর্মকা-ে নিয়োজিত করে তাদের পণ্যের বিক্রয় ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এবং দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা। ৪. ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসাসেবা চালু করা এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য বৃত্তিপ্রথা চালু। এটি বর্তমানে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় ‘দুঃস্থ’ মহিলা ও ‘শিশুকল্যাণ তহবিল’ নামে পরিচালিত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিজীবনেও বেগম মুজিবকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের নানা পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। তিনি বাংলাদেশে প্রথম নারী সংগঠন জাতীয় মহিলা সংস্থার ভিত্তি রচনা করেন। বঙ্গবন্ধু নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও তাদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় জাতীয় মহিলা সংস্থা।
বঙ্গবন্ধু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়ে বলতেন, নারীর নিজস্ব আয় থাকলে পরিবারেও সম্মান বাড়ে। যদি তার সামান্য কিছু টাকাও থাকে, পরিবারে তার গুরুত্ব বাড়ে এবং পরিবার তাকে সম্মানের চোখে দেখে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন পরিবার থেকেই নারীর ক্ষমতায়ন শুরু করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার উপার্জনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের। এই প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চালু করা হয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। গ্রামীণ নারীরা কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন বলেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত করার কথা ভাবেন। এই লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে সাভারে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের ৩৩ বিঘা জমির ওপর চালু করা হয় কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির মূল ভিত্তি নারীর শিক্ষা। নারী শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে জাতির পিতা নারীর জন্য চালু করেন স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণশিক্ষা কার্যক্রম। নারীরা ব্যাপকভাবে এতে অংশ নেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনেপ্রাণে নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করতেন। নারী-পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে না এলে, কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয় তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- ‘নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে কল-কারখানাতে, সৈন্যবাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে। সত্য কথা বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না। নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ আর পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর।’ তিনি আরও লিখেন, ‘নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতি গঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’
জাতির পিতা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই নারীকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতা চলছে এখন। বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের অধীনে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ এবং সিটি করপোরেশনের আইনগুলো যুগোপযোগী করে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটির প্রত্যেকটিতে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে স্থানীয় সরকার আইনে সাধারণ আসনে নারী প্রার্থীর অধিকার ঠিক রেখে প্রতি ইউনিয়নে তিনটি সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধান করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর ফলে তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়। উপজেলা পরিষদে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়। সেখানে তারা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন।