2506
Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2021জুলিও কুরী শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তিতে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বশান্তি পরিষদে ভাষণ
-----
"লাখাে শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন বাংলার পবিত্র মাটিতে প্রথম এশীয় শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য আগত শান্তির সেনানীদের জানাই স্বাগতম। উপনিবেশবাদী শাসন আর শােষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিরােধ করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি তথা আঞ্চলিক শান্তির অপরিহার্যতা।
এই পটভূমিতে আপনারা বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে 'জুলিও কুরী’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন । এই সম্মান কোন ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের- 'জুলিও কুরী' শান্তি-পদক সমগ্র বাঙালী জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্বশান্তি পরিষদ যেমন আমাদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেছিলেন, এদেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সাথে সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছেন। আমি নিজে ১৯৫২ সালে পিকিং-এ অনুষ্ঠিত প্রথম এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলীয় শান্তি সম্মেলনের একজন প্রতিনিধি ছিলাম। বিশ্বশান্তি পরিষদের ১৯৫৬ সালের স্টকহােম সম্মেলনেও আমি যােগ দিয়েছিলাম। একই সাথে এটাও আমি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, বিশ্বশান্তি আমার জীবনদর্শনের মূলনীতি। নিপীড়িত, নির্যাতিত, শােষিত, শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ, যে কোন স্থানেই হােক না কেন, তাঁদের সাথে আমি রয়েছি। আমরা চাই বিশ্বের সর্বত্র শান্তি বজায় থাকুক, তাকে সুসংহত করা হােক। বৃহৎ শক্তিবর্গ, বিশেষভাবে আগ্রাসী নীতির অনুসারী কতিপয় মহাশক্তির অস্ত্রসজ্জা তথা অস্ত্র প্রতিযােগিতার ফলে আজ এক সঙ্কটজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই, অস্ত্র প্রতিযােগিতায় ব্যয়িত অর্থ দুনিয়ার দুঃখী মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়ােগ করা হােক। তাহলে পৃথিবী থেকে দারিদ্রের অভিশাপ মুছে ফেলার কাজ অনেক সহজসাধ্য হবে।
আমরা সর্বপ্রকার অস্ত্র প্রতিযােগিতার পরিবর্তে দুনিয়ার সকল শােষিত ও নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে বিশ্ববাসী বলেই বিশ্বের সব দেশ ও জাতির বন্ধুত্ব কামনা করি। সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের এই নীতিতে আমরা আস্থাশীল। তাই সামরিক জোটগুলাের বাইরে থেকে সক্রিয় নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি। শুধু সরকারের নীতিই নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতি সুদৃঢ় করা আমাদের সংবিধানের অন্যতম অনুশাসন। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আমাদের সংবিধান জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চারটি স্তম্ভের উপরই রচিত। এই আদর্শের ভিত্তিতেই আমরা একটি শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চাই।
আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আলােকেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য আমরা অনুধাবন করেছি। আমরা জানি, মুক্তিকামী মানুষের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করা যায় না। সেজন্য ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, লাওস, এ্যাঙ্গোলা, মােজাম্বিক, গিনি বিসাউসহ দুনিয়ার সকল উপনিবেশ-বিরােধী সংগ্রামের প্রতি আমরা জানিয়েছি অকুণ্ঠ সমর্থন। আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করি অন্যায়ভাবে আরব এলাকা ইসরাইল কর্তৃক জোরপূর্বক দখলে রাখার বিরুদ্ধে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে নিন্দা করি দক্ষিণ আফ্রিকা সহ বিশ্বের সকল স্থানের বর্ণভেদবাদী নীতির। আমরা সমর্থন জানাই বিশ্বশান্তি, নিরস্ত্রীকরণ ও মানব কল্যাণের যে কোন মহৎ প্রচেষ্টাকে। বিশ্বশান্তি ও মানবকল্যাণ আমাদের অন্যতম মূলনীতি হওয়ার জন্যই শুরু থেকে আমরা এই উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তির জন্য চেষ্টা করে আসছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানের বৈরী মনােভাবের দরুন আমাদের প্রচেষ্টা ফলবতী হয়নি । পাকিস্তান বার বার উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করে এসেছে। স্থায়ী শান্তি ও মানব কল্যাণে আমাদের উদ্যোগের সর্বশেষ প্রমাণ ১৭ই এপ্রিলে ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত ঘােষণা । এই ঘােষণায় স্থায়ী প্রতিষ্ঠার সূত্র খুঁজে বের করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবে অনুকূল সাড়া দেয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বেআইনীভাবে আটক নিরাপরাধ বাঙালীদের বন্দীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এইভাবে পাকিস্তানের একগুয়ে নীতি উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ আবার নতুন করে পাকিস্তানকে সজ্জিত করে চলেছেন নতুন নতুন সমরাস্ত্রে। নিঃসন্দেহে এটা স্থায়ী শান্তির যে কোন শুভ উদ্যোগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। আমি এর প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জয় বাংলা। জয় বিশ্বশান্তি।"
সূত্রঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মদ হাননান সম্পাদিত "শ্রেষ্ঠ বাঙালি" সংকলন থেকে সংগৃহীত