2503
Published on ফেব্রুয়ারি 26, 2021মুঈদ রহমানঃ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব সূচিত হয়। একটি জাতির জন্ম কবে তা বলা মুশকিল, তবে দীর্ঘ পথপরিক্রমায়, নানারকম বিপত্তি পেরিয়ে কবে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণে সমর্থ হয়, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সে হিসেবে বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছর ধরে হলেও স্বাধীন জাতি হিসেবে তার বয়স মাত্র ৪৯ বছর, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ।
আমরা অনেক সময় গােলমেলেভাবে জাতির সংজ্ঞা নিরূপণে সচেষ্ট হই: কিন্তু আখেরে তা বাস্তবতার মুখ দেখে না। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়। আমরা জাতির সংজ্ঞা হিসেবে ধর্মকে টেনে এনেছিলাম- হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ-পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের সবটাই ছিল বাঙালি বাস। জোড়াতালি দিয়ে জাতি হয় না। একটি, জাতি দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তৈরি হয়। সৃষ্টি হয় তার ভাষা, সংস্কৃতি। একক এবং একমাত্র উপাদান হিসেবে ধর্ম বিবেচিত হতে পারে না। তা-ই যদি হতাে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ২২ জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হতাে না। তৎকালীন পাকিস্তানেও তা বাস্তব রূপ পায়নি। মাত্র ২৩ বছরের মাথায় ধর্মের খােলস থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালি তার নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় ।
এ জন্মক্ষণ হঠাৎ করে কিংবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়নি। পার করতে হয়েছে অসংখ্য বিনিদ্র রজনী। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক ও শােষকগােষ্ঠী একদিকে ছিল সাম্প্রদায়িক, অন্যদিকে ছিল জনগণবিমুখ তাদের চরিত্র ছিল পুরােমাত্রায় সমস্তীয় এবং দীর্ঘ ৭৩ বছর পর আজও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান। সে সময়ে মুসলিম লীগের নেতারা চট্টগ্রাম-সিলেট বেড়ানাের পরিবর্তে বিলেত-ইউরােপকে অধিকতর পছন্দ করতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোনাে সংযােগ-সম্পর্ক ছিল না। তাই মাত্র দুই বছরের মাথায় এ দেশের বাঙালি রাজনীতিকরা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৪৯ সালে তৈরি করেন "আওয়ামী মুসলিম লীগ” এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু আমজনতার ‘পালসটা বুঝতেন, তাই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে সৃষ্টি হওয়া একটি রাষ্ট্রে অনায়াসেই একটি অসাম্প্রদায়িক দল গড়তে কুণ্ঠা করেননি। পশ্চিমা শাসকরা আমাদের বাঙালি জাতি হিসেবে টিকে থাকতে দিতে চায়নি বলেই তৈরি হয়েছিল '৫২; ভাষার দাবিতে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার রাজপথ। সে থেকে শুরু হয় স্বাধীন সৃষ্টির পথচলা। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামাের ভেতরে থেকেই বাঙালি স্বাধিকারের সর্বোচ্চ দাবি তােলে। এরই পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায় পশ্চিমারা তৈরি করে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযােগ এনে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে মােট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর প্রতিবাদে সর্বসাধারণের সর্বোত প্রতিবাদের মুখে সৃষ্টি হয় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, যার ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হন। পাকিস্তানকে মেনে নিয়ে বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ প্রচেষ্টা ছিল ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ১০ শতাংশ ভােট পেয়ে আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আর প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনেই বাঙালি আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দেয়। এত সমর্থনের পরও পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অপরাগতার মনােভাব প্রকাশ করে এবং হিংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কুপ্রচেষ্টা আমাদের স্বাধীন জাতি গঠনের বিকল্প সব পথ বন্ধ করে দেয়। ৩ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশন হওয়ার পূর্ব ঘােষণা থাকলেও শাসকগােষ্ঠী ১ মার্চ তা স্থগিত করে দেয়; চূড়ান্ত ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র- জনতা কসম খেয়ে নেমে পড়ে রাজপথে। আর এক মুহূর্তও পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে রাজি নয় সমগ্র বাঙালি। বাঙালির এ দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখা স্বপ্নের বাস্তব ঘােষণা আসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। এ ঘােষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির চিত্তলােকে স্বপ্নপূরণের বীজটি বপন করে দেন। এ ঘােষণার পর নতুন জাতির স্বপ্নপূরণ ছিল নেহায়েতই সময়ের ব্যাপার। তবে স্বাধীনতা লাভের পর বাঙালি জাতি যে দেশটিতে বাস করবে তার নাম হবে কী? বঙ্গবন্ধু এর একটি বিহিত সাধারণ নির্বাচনের আগেই করে ফেলেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেন- আমি যদি কখনও পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সুযােগ পাই, তবে এ প্রদেশের নামকরণ করব বাংলাদেশ। এ দেশের বুক থেকে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা থেকে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনাে কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘােষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ ।
৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বিভাগগুলাে, সচিবালয়, হাইকোর্ট, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলাে, কলকারখানা সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১০ মার্চ এক সামরিক আদেশে সব কর্মকর্তা- কর্মচারীকে কাজে যােগদানের নির্দেশ দিলেও কোনাে বাঙালিই তা মেনে নেননি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে সামরিক বাহিনীকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২৩ মার্চ দেশজুড়ে পাকিস্তান দিবস উদযাপনের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে এমনকি বিদেশি দূতাবাসগুলােতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। সে সময়টাতে কোনাে ধরনের আপসরফার কোনাে সুযােগ থাকল না। সেদিন দিনভর মিটিং-মিছিল শেষে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হয় ছাত্র-জনতা। তাদের উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু মুক্তির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, কারাে সামনে মাথা নত করবাে না। দরকার হয় আরও রক্ত দেব কিন্তু বাংলার মানুষকে আর আমরা পরাধীন থাকতে দেব না। আপনাদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার সংগ্রাম চলবে। 'জয় বাংলা' (ওঙ্কার সমগ্র; পৃষ্ঠা : ১৮)।
পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী এ সময়টাতে একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের দিকে পা না বাড়িয়ে গণহত্যার দিকে পা বাড়ায়। আর এ নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু করার জন্য বেছে নেয় ২৫ মার্চ রাত; নাম দেয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। মূল ঘােষণাটি ছিল ইংরেজিতে, যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "এটাই হয়তাে। আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মােকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসীকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে" (হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধঃ দলিলপত্র'; ৩য় খণ্ড; পৃষ্ঠা : ১)।
আজকের কথা এখানেই শেষ করা যেত; কিন্তু আমাদের দেশে অপরাজনীতির ধারা অনেক সময়েই ইতিহাসকে আক্রান্ত করে ফেলে । স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে তেমনই অবান্তর কথার অবতারণা করা হয়ে থাকে। অত্যন্ত সংকীর্ণ আর 'নির্বোধ একদল মানুষ প্রচার করতে আগ্রহী যে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘােষক। জিয়াউর রহমানের আমার রাজনীতির রূপরেখা’র একটি পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ বের করা হয়েছে। তাতে জিয়াউর রহমানের পরিচিতির জায়গায় লেখা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। এটি শুধু মিথ্যাচারই নয়, অজ্ঞতার পরিচায়কও বটে । তারিখটি ২৬ নয়, ২৭ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সামরিক সিদ্ধান্ত নয়। সুতরাং রাজনৈতিক নেতাই সেই 'অথােরিটি রাখেন এবং তা মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা মাে. আবদুল হান্নান চট্টগ্রামের কালুরঘাটি বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেই স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। এখানে 'পাঠ করা আর ‘ঘােষণা করার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করাটা জরুরি। উল্লিখিত বইটির 'আমি জিয়া বলছি' অধ্যায়ে ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তাতে লেখা আছে, আমাদের মহান নেতা, বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা এত দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করছি এবং ঘােষণা করছি যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই সরকার গঠিত হয়েছে (পৃষ্ঠা : ১৭৭)। তবে আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেন? জিয়াউর রহমানের লিখিত একটি নিবন্ধ ছিল একটি জাতির জন্ম। সেখানে তিনি '৫২ থেকে '৭১ পর্যন্ত বাঙালির আন্দোলনের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। নিবন্ধটির শেষ তিন লাইন ছিল, তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট, ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সাল । রক্ত আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণে রাখতে ভালােবাসবে' (জিয়াউর রহমান, আমার রাজনীতির রূপরেখা;, পৃষ্ঠা : ২৫)। কই তিনি তাে ঘােষণা দেয়ার কথা বলেননি! এ কারণে যে, ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার আপডেট মাত্র। সে সময়ে সেনাবাহিনীর ভেতর বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নিজেদের যুদ্ধে নিয়ােজিত করার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ঘােষণা পাঠ করার প্রয়ােজনীয়তা ছিল । সে হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসের একটি অংশ হতে পারেন। তবে অবশ্যই তা 'স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠক' হিসেবে, কোনাে মতেই 'ঘােষক' হিসেবে নয়।
সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু- স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, ড. আনু মাহমুদ