8307
Published on ফেব্রুয়ারি 15, 2021মো সাখাওয়াত হোসেনঃ
সবচেয়ে বিশাল ও ভারি যে লাশটি বাংলাদেশ নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবের লাশ'—হুমায়ুন আজাদ এ একটি উক্তির মাধ্যমেই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রগাঢ়তা এবং ব্যাপকতা উল্লেখ করা যায়। বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অসংখ্যবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও হয়তবা ঘটতে পারে কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব সারা বিশ্বের মেহনতি এবং শোষিত মানুষের কষ্ঠকে বিদ্ধ করে দিয়েছিল, বন্ধ করে দিয়েছিল প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বরকে। বিশ্বের নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে দেখা হতো। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশ্বকে তার বক্তব্যের মর্মার্থ বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি শোষিত মানুষের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাবেন এবং নিজের জীবন দিয়ে বক্তব্যের যথোক্তি প্রমাণ করেছেন। মৃত্যু-অবধি গরিব দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন। আর তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলার জমিনে। নিষ্ঠুর থেকেও নিষ্ঠুরতম ছিল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি। ইতিহাসের অন্যতম রাজনৈতিক এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে। বাংলার মানুষ আজও বঙ্গবন্ধুর শোকে মুহ্যমান, নিজের বিবেকের কাছে সকলেই দেনার দায়ে জর্জরিত।
বাংলা, বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এ শব্দযুগলগুলো একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে। নিজের যৌবন, পারিবারিক দায়িত্ব সবকিছুকে পেছনে ফেলে তিনি বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর বাঙালি যেন সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে বিশ্বের মানচিত্রে। তিনি তাঁর লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করেছিলেন এবং বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিলে তিলে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর সারা-জীবনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে পূরণ করার গৌরব দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টায় বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তিনি অস্থিমজ্জায় লালন করেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার মুক্তি ও বাস্তবিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন সংগ্রামী চেতনা। তাই তো, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বর্ণাঢ্য সংগ্রামী জীবনের অধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু কেমন নেতা ছিলেন সে প্রশ্নকে সামনে নিয়ে কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রথমত, একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত সংখ্যক বই বের হয়েছে বিশ্বের অন্য কোন নেতার নামে কিংবা স্মরণে এতগুলো বই বের হয়নি। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধ রাজনীতিটাকে নিজের পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, অস্থিমজ্জায় ধারণ করেছিলেন। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে তৎসময়ে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি মুক্তি সংগ্রামে পিয়ে পড়েছিলেন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। চতুর্থত, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আনিত মাধীনতাকে এখন পর্যন্ত কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তাকে কেউ অস্বীকার করেনি। পঞ্চমত, স্বাধীনতার পরেও ক্ষমতার ললাট কখনই বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি গণভবন/বঙ্গভবন রেখে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। ষষ্ঠত, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নেতাকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় মুজিব ভাই। এ রকম বহুমুখী গুণের অধিকারী ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে উল্লেখ্য, প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং নতুন রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতির ব্যাকরণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে ইতোমধ্যে।
প্রকৃত অর্থে, বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনকাল (ঘটনাবহুল) হচ্ছে গবেষণার বিষয়বস্তু, রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট। একটা মানুষ কিভাবে সাধারণের কাছে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে—সেটাই গবেষণায় উঠে। আসতে পারে। তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের কালে শেখ মুজিবের জীবনকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে। তিনি রাজনীতিটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, কবির তুলির ন্যায় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণের ছাপ রাখতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সংসার, ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিয়ে তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে শেখ মুজিবের সহধর্মিণী হিসেবে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদান ছিল ভূয়সী প্রশংসার। কেননা, স্বামীর অবর্তমানে (কারান্তরীণ) তিনি সংসারকে টিকিয়ে রেখেছিলেন পরম দৃঢ়তায় ও দক্ষতায়। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ সাংসারিক দায়িত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের দিক-নির্দেশনায়ও তিনি ছিলেন অনন্য, যোগ্য সহধর্মিণী। ছাত্রনেতাদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের খোঁজ-খবর রাখার পাশাপাশি নানাভাবে সহযোগিতা ও মামলা পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বাংলার মুক্তির সংগ্রামে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি অনন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং বেগম মুজিব কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে শেখ মুজিব ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদানের স্বরূপ তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ।
আগস্ট মাস-বাঙালির শোকের মাস। কারণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাতে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যরা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করে দেশী-বিদেশী কুটিলদের চক্রান্তে। অথচ যে বাঙালির জন্য সারাজীবন নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সে বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবে সপরিবারে সেটি কখনও তিনি নিজেই চিন্তা করতে পারেননি। বিভিন্ন মাধ্যমে বিশেষ করে দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে বারংবার হত্যার ছক সম্বন্ধে জানালেও তিনি ছিলেন নির্ভার তিনি বলেছিলেন, বাঙালি কখনই আমাকে হত্যা করতে পারে না। কারণ, জাতশত্রু পাকিস্তান বারংবার সুযোগ পেয়েও বঙ্গবন্ধুর পাহাড়সম দৃঢ়তা এবং পশ্চিমা বিশ্বের চাপের কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস পায়নি। সে বিবেচনায় যে বাঙালির জন্য তিনি নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন সে বাঙালি তাকে কিভাবে হত্যার সাহস করবে? তাই শেখ মুজিব কোন গোয়েন্দা রিপোর্টে বিশ্বাস করতেন না এতদসংক্রান্তে। অবশ্য বাঙালির ওপর অতীব বিশ্বাসই কাল হয়ে দাড়ায় শেখ মুজিব ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের জন্য।
ঘটনার বিভীষিকা ভাবলেই গা-শিউরে উঠে। চিন্তা করা যায়, ছোট্ট শিশু রাসেলকে রেহাই দেয়নি খুনীচক্র। রেহাই পায়নি গর্ভবতী রমণী। কি হত্যার যবনিকাপাত রচনা করেছিল খুনীচক্র! কেবল, রেহাই পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে। খুনীচক্র ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোন সদস্য বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর ন্যায় বজ্রকণ্ঠ ধারণ করবেন। সে কারণেই সবাইকে খুন করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড বিশ্বের যে কোন হত্যাকাণ্ডকে হার মানিয়ে দেয়। এ রকম ঘটনা খুবই দুর্লভ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধুর মতো বলিষ্ঠ নেতাকে হত্যা করার মিশন চাট্টিখানি কথা নয়! পাকিস্তানি জনারেলরা যেখানে বঙ্গবন্ধুর সামনে আসলে চুপসে যেত সেখানে বাঙালি জওয়ানরা স্বাধীনতার জনককে হত্যা করেছে বিষয়টা খুবই গর্হিত এবং অবিবেচনাপ্রসূত। গুলির চিহ্ন এখনও স্পষ্ট দেখা যায় ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িতে।
কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো?এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসলে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা হয়ে থাকে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর আনিত স্বাধীনতাকে খুনীচক্র এবং তাদের দোসররা মেনে নিতে পারেনি এবং এ চক্রটি স্বাধীনতার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে থাকে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রকল্প হাতে নেয়ার ফলে বঙ্গবন্ধু এক শ্রেণীর শোষকদের রোষাণলে পড়েন। কারণ, বিপথগামীরা বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসবে। তৃতীয়ত, তৎকালীন পশ্চিমা গোষ্ঠীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কারিশমাকে মেনে নিতে পারেনি; কেননা নতুন রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু একের পর এক গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে। চতুর্থত, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের ষড়যন্ত্রকে বঙ্গবন্ধু কখনই গুরুত্বের সহিত বিবেচনায় নিতেন না, তিনি ভাবতেন বাঙালি কখনই বঙ্গবন্ধুর ক্ষতি করতে পারে না। পঞ্চমত, দেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য গ্রহণীয় পদক্ষেপের বাস্তবায়নের বিরোধিতাকারীগণই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রভাবে বাঙালি জাতি হাজার বছর পিছিয়ে গেছে উন্নয়ন এবং সামগ্রিকতার স্বার্থে। সারাবিশ্ব পরবর্তীতে বাঙালিকে খুনী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। কেননা, স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতাকে বাংলার কুটিল চক্র যখন হত্যা করে খুনের মরণনেশায় মেতে উঠে তখন সে দেশটি বিপদাপন্ন হয়ে উঠে বিপথগামী সদস্যের দ্বারা। ভূ-লুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রিক কাঠামো, নষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে বাংলাদেশের সার্বিক কাঠামো নষ্ট হয়ে যায়, ক্ষমতায় আসে সেনাশাসিত সামরিক সরকার। স্বাধীনতার চেতনাকে নষ্ট করার জন্য উঠে পড়ে লাগে তৎকালীন সরকারগুলো। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের পরবর্তীতে পুরস্কার দেয়া হয়ে থাকে নানাভাবে। বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করা হয় আত্মস্বীকৃত খুনীদের জন্য, ফ্রিডম পার্টি তৈরির মাধ্যমে সংসদেও শেখ মুজিবের হত্যাকারীরা প্রতিনিধিত্ব করে। খুনীরা যে ক্ষমতালিন্দু শাসকদের মদদে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল সেটি অত্যন্ত স্পষ্ট। পাশাপাশি ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় খুনীচক্র। কিন্তু মুজিবপ্রেমীরা ক্রমে ক্রমে সংঘটিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ছিলেন বদ্ধপরিকর। সকল বাধা-বিপত্তিকে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ হয় মুজিবপ্রেমীরা, ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের কার্যক্রম হাতে নেয় এবং বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করে। আগস্ট মাস মাতমের মাস, শোকের মাস। এ মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন; যত দ্রুত সম্ভব বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায়কৃত শান্তি কার্যকর করা হোক, যাতে কিছুটা হলেও দায়মুক্তি মিলে বাঙালির। বিনম্রভাবে জাতির পিতাকে স্মরণ করছি।