5043
Published on ফেব্রুয়ারি 14, 2021আনিসুজ্জামান অনূদিত:
শেখ মুজিবুর রহমান যখন গত সপ্তাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন তার কিছু সমালোচক বলেছিলেন যে, তিনি শুধু তার চরমপন্থী সমর্থকদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করছেন এবং ঢেউয়ের ধাক্কায় যাতে তলিয়ে না যেতে হয়, তাই ঢেউয়ের ওপর চড়ার চেষ্টা করছেন। তবে এক অর্থে, এক নতুন বাঙালি জাতির যোদ্ধী-নেতারূপে মুজিবের আবির্ভাব বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের জন্য তার আজীবন সংগ্রামেরই যুক্তিযুক্ত পরিণতি । মুজিব হয়তো এখন ঢেউয়ের চূড়ায় সওয়ার হয়েছেন; কিন্তু ওখানে তার থাকাটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়।
ঠিক ৫১ বছর আগে, ঢাকার নিকটবর্তী এক গ্রামে, সম্পন্ন ভূম্যধিকারি পরিবারে মুজিবের জন্ম। শিক্ষাজীবনের গোড়ায় বুদ্ধিবৃত্তিগত কোনো কৃতিত্বের পরিচয় তিনি দেননি। বালক হিসেবে তিনি ছিলেন বহির্গামী ও জনপ্রিয় মানুষজন, খেলাধুলা, গল্পগুজব পছন্দ করতেন। কলা বিষয়ে ডিগ্রি লাভের জন্য তিনি যখন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান, ততদিনে মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তখন তার অগ্রণী ছিলেন এইচ, এস. সোহরাওয়াদী, যিনি ব্রিটিশ রাজের অধীনে বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী এবং পরে বছরখানেকের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুজিব আইন পড়েছিলেন, তবে সোহরাওয়ার্দীর মতো নরমপন্থীর সঙ্গে তার মিল ছিল না; খুব অল্পকালেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ঝোক দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে। চল্লিশের শেষদিকে এরা দু'জনেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাদের মাতৃভূমি বাংলা প্রাপ্যের তুলনায় কম পাচ্ছে। মুজিব নামলেন পথের আন্দোলনে এবং বেআইনি ধর্মঘট ও বিক্ষোভে নেতৃত্বদানের দায়ে বার দুয়েক গ্রেফতার হলেন।
কারাগার থেকে বেরোবার পর আওয়ামী লীগে মুজিব হয়ে উঠলেন সোহরাওয়ার্দীর ডান হাত; কিন্তু আপস করে অন্যান্য দলের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করার ক্ষেত্রে তার নেতার প্রয়াস ধূলিসাৎ করে দিলেন। মুজিবের প্রয়াসের সাফল্যে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে সমর্থ হলো এবং বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীরূপে মুজিব সাত মাস দায়িত্ব পালন করলেন। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আপাতদৃষ্টিতে মুজিব আর বয়স্ক নেতার নরমপন্থী নীতির বাধা তেমন করে অনুভব করলেন না। তিনি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করলেন, নিজের সহজাত রীতির রাজনীতি অনুসরণ করলেন এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করলেন। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তখন মোহাম্মদ আইয়ুব খান তাকে আবার গ্রেফতার করলেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় প্রকাশ্য বিদ্রোহ দেখা দিল এবং সেই আলোড়নে আইয়ুব মুজিবকে মুক্তি দিতে এবং নিজে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। নিজের জনগণের কাছে মুজিব আত্মপ্রকাশ করলেন বীরপুরুষ হিসেবে।
বাঙালিদের তুলনায় মুজিব লম্বা (উচ্চতায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি), চুলের এক গুচ্ছে পাক ধরেছে, ঘন গোফ, সতর্ক দুটি কালো চোখ। লাখ লাখ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাক্তিতার তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মােহিত করে রাখতে পারেন। একজন কূটনীতিবিদ বলেন, 'একাকী তার সঙ্গে কথা বলার সময়েও মনে হয় তিনি যেন ৬০ হাজার লোককে সম্বােধন করে বক্তৃতা দিচ্ছেন।' উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি- পাকিস্তানের তিনটি ভাষায় তার পটুত্ব আছে। নিজেকে মৌলিক চিন্তাবিদ বলে ভান করেন না মুজিব। তিনি রাজনীতির কবি- প্রকৌশলী নন; তবে বাঙালিরা যত না প্রায়োগিক, তার চেয়ে শৈল্পিক বেশি। কাজেই, এই অঞ্চলের সকল শ্রেণী ও মতাদর্শকে ঐক্যবদ্ধ করতে যা প্রয়োজন, তার রীতিতে হয়তো ঠিক তা-ই আছে।
এক মাস আগে, মুজিব যখন প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত থাকছিলেন, তখন নিউজউইকের লোরেন জেনকিনসকে একান্তে তিনি বলেছিলেন, 'পরিস্থিতি বাঁচানোর আশা তার নেই। আমরা যেভাবে দেশটাকে জানি, তা শেষ হয়ে গেছে। তবে ভাঙার কাজটা যাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানই করেন, তিনি তার অপেক্ষায় ছিলেন। আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং আমরা বেরিয়ে যেতে পারি না। ওরা, পশ্চিমারা সংখ্যালঘু, বিচ্ছিন্ন হওয়াটা তাদের ইচ্ছাধীন। সঙ্কট ঘনীভূত হলে দু'সপ্তাহ পর শত শত বাঙালি ঢাকার প্রত্যন্তে মুজিবের বাড়ির প্রাঙ্গণে ও বারান্দায় সমবেত হতে থাকে। পাইপ (বিদেশি এই একটি জিনিসই আমি ব্যবহার করি) টানতে টানতে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন প্রফুল্লচিত্তে। এরকম এক উৎসাহী জনসমাবেশের উদ্দেশে বক্তৃতা দেয়ার পর পাশ্চাত্য সাংবাদিকদের দিকে ফিরে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ভোর পাঁচটা থেকে ক্রমাগত এমন চলতে থাকে। আপনারা কি মনে করেন, মেশিনগান দিয়ে এই তেজ দমন করা যাবে? কয়েকদিন পর একজন সেই চেষ্টাই করলেন।
(১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত নিউজউইকে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল।)
সূত্রঃ সূত্রঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মাদ হাননান