সন্তোষ গুপ্তঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেকে হত্যা করা হয়েছে আজ থেকে বিশ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। তাঁকে হত্যা যারা করেছে সেদিন তাদের দেয়া যুক্তি আর কিছু রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের দেয়া বিবৃতি ও সভা-সমিতিতে তাদের ভাষণের আশ্বর্য মিল দেখে আমাদের মনে কি কখনাে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মানসিক সহযােগী আমাদের অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। আর এ জন্যই কি নিহত হওয়ার ২০ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার দাবি তাঁর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ এবং সহযােগী দু'চারটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে করা হলেও অন্যন্য রাজনৈতিক দলগুলাে নানাভাবেই তার হত্যার পক্ষে যুক্তিজাল আজও বিস্তার করে চলেছে।
আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের শাসনকালকে আজও যারা দেশব্যাপী নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, দুর্নীতির যুগেও দুঃশাসনের শাসনকাল বসে অভিহিত করে, তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের নিকট-সহযােগী। তারা ক্ষমতার সঙ্গে আছে, তারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। টেকনিক্যালি তারাও বিরােধী দলের পর্যায়ে পড়ে। আন্দোলনের ঐক্য বজায় রাখার খাতিরে ৮০ দশকেও তারা এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝােতায় এসেছে এ কথা বলে আমরাও শেখ মুজিবের হত্যার বিচারের দাবি করবাে। তােমরাও আমাদের নেতাদের কিংবা সকল রাজনৈতিক হত্যার বিচার পাইকারি সমর্থন করাে । এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃত অর্থে দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু থাকলে আইনের শাসনের নিজস্ব ধর্মে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সমূহের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু যেসব রাজনৈতিক দল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেনি কিংবা এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে এগিয়ে আসেনি, তারা শেখ মুজিবের হত্যার বিচারের দাবির প্রতি রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের লক্ষ্যে 'অশ্বথমা হত ইতি গজ' ধরনের সমর্থন দিয়ে এসেছে।
তার কারণ এই যে, তারা তাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে বাঙালি জাতির বৃহত্তর স্বার্থ, সমাজ ও স্বদেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অগ্রগতির ধারার বাঁকে বাঁকে যে মূল্যবােধগুলাে সমৃদ্ধ হয়েছে বহু মনীষীর কাজে ও চিন্তায়, তা সম্যক উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কিংবা বিবেচনায় আনতে চাননি। ফলে তাদের দোলাচল চিত্তবৃত্তি বারবার তাদের ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গঠন করে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণে ইতস্তত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসে পাকিস্তান আমলে বার বার নিজস্ব গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। '৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ফলে আমাদের সমাজের বহির্বাস্তবে যে বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়েছে তাই তাঁকে পথ দেখিয়েছে তৎকালীন পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে। তখন কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন ছিল। আমাদের মনে রাখা দরকার, পৃথক নির্বাচন প্রথার মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই আদর্শ ও নীতি পরিবর্তনের শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিব বাঙালি জাতির পরিচয়কে ক্রমশ স্পষ্টতর করে তুলেছিলেন এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
চর্যাপদের যুগ থেকে বাঙালি জাতির চেতনার বিকাশকে মধ্যযুগ পার হয়ে ক্রমেই পূর্ণতা দেয়ার পথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিব। তখনও তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি, বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাঙালি জাতির হৃদয়ে স্থান গ্রহণ তা আরাে পরের কথা। এজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত। বাঙালি জাতির মানসলােক গঠনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের মতাে মানবতাবাদীদের যােগ্য উত্তরসূরি হিসেবে জাতির সমাজজীবনে এই চেতনার বিকাশে আমরা পেলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
অথচ আমরা এখনও তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারিনি। শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচি ঘােষণা করলেন বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির সনদ হিসেবে। আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, সেদিনও যারা নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল, তারা এই ৬ দফাকে অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছিল? এ প্রশ্নের জবাব দেয়া অনেকের নিকট বিব্রতকর মনে হবে আজকের দিনেও, কারণ সেদিন সামরিক শাসনবিরােধী কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলও স্পষ্টভাবে তাঁকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেনি । বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও কার্যত নীরব ছিলেন, রাজনীতি ছিল তাদের চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের বাইরে।
অথচ রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার অনুরাগী শেখ মুজিব কবিগুরুর সেই শিক্ষাকে আত্মস্থ করেছেন সকলের অলক্ষ্যে। তিনি উপলব্ধি করেছেন, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা সংখ্যালঘুর বিচারে কোন জনগােষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রাম সার্থক হয়ে উঠতে পারে। না। তাদের মধ্যে মিলনের ক্ষেত্র হওয়া চাই ব্যাপক তার ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির বন্ধন তাকে ঐক্যের বন্ধনে যেভাবে বাঁধতে পারে তেমন আর কিছুতেই নয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের হিন্দু-মুসলমান সমস্যা, তাদের মধ্যে বিরােধ ভেদবৃদ্ধির কুৎসিত রূপ দেখে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৩২ সালেই। তিনি বলেছিলেন, 'যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোন বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেইটা সকলের চেয়ে সর্বনেশে বিভেদ। মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটিকেই সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি। যে দেশে ধর্মই সেই বুদ্ধিকে পীড়িত করে রাষ্ট্রিক স্বার্থ বুদ্ধি কি সে দেশকে বাঁচাতে পারে?'
সেই রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধির ভয়াবহ প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে, যখন বাঙালি জাতির ওপর ধর্মের নাম করে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তারা বলপ্রয়ােগ, গণহত্যা, নারিত্বের অবমাননা করেছে। ধর্ম রক্ষা নয়, বর্বরতার অস্ত্রে তাকে পীড়িত করেছে। এর বিরুদ্ধেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমগ্র জাতিকে একত্র করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এই মুক্তি শুধু দাসত্ব থেকে, শােষণ থেকেই নয়, মূঢ়তা থেকেও মুক্তি। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় তিনি বলেছিলেন, "আমি স্পষ্টষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছি, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। দেশে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই, শােষণের স্থান নেই। দেশের কৃষক, শ্রমিক, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।"
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এই কথাগুলাে পরবর্তী সময়ে আমাদের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। আমরা সকলে তাঁর এই ভাষণ কিংবা সংবিধানের মূলনীতির প্রতি যথেষ্ট আস্থা স্থাপন করেছিলাম, এ কথা সত্য নয়। শ্ৰেণীসংগ্রামের নাম করে যে শক্তি তৎকালে আওয়ামী লীগ সরকার ও বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রমের বিরােধিতা করেছিল, সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতিকে বিপ্লব আখ্যা দিয়েছিল, তারাই প্রত্যক্ষ না হলেও পরােক্ষভাবেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্রান্তের শক্তিকে উৎসাহিত করেছিল । এজন্য বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর উগ্র বাম রাজনীতির প্রবক্তাগণ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারকগণ স্বাধীনতাযুদ্ধের পরাজিত শক্তির মতােই উল্লসিত হয়েছিল। এবং বাংলাদেশ আধিপত্যবাদের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছিল। এবং একই বছর নভেম্বরের ৭ তারিখ তথাকথিত সিপাহি-জনতা বিপ্লব দেশ বিক্রি সর্বশেষ চক্রান্ত ব্যর্থ করেছে এ কথা বলতে কুণ্ঠিত হয়নি
এই শক্তিই অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলােতে বঙ্গবন্ধুর সমালােচনা করে প্রচারপত্র বিলি করেছে এবং সাপ্তাহিক লিখেছে যে, শান্তিপূর্ণ হরতাল, ধর্মঘট ও অসহযােগ আন্দোলন নয়, চাই সশস্ত্র বিপ্লব। শেখ মুজিব যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ১৭ মার্চ পূর্ণাঙ্গ আলােচনা সভায় বসেন, তার তিনদিন পূর্বে এক বিবৃতিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "বাংলাদেশের মুক্তির উদ্দীপনা নিভিয়ে দেয়া যাবে না। আমাদের যাবে না পরাজিত করা। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন হয়ে ও মর্যাদার সাথে বাস করতে পারে তার নিরাপত্তা বিধান করার জন্য আমরা প্রত্যেকে প্রয়ােজন হলে মরতেও কৃত সংকল্প ... যে কোন ত্যাগের জন্য তৈরি হয়ে থাকতে হবে এবং তাদের (জনগণের) বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগ করা হলে সম্ভাব্য সর্বোপায়ে তা প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
তারও আগে ১১ মার্চ সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বিদেশী বিশেষজ্ঞদের বিতাড়নের তীব্র প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “জনবিরােধী। হঠকারী চক্র উন্মত্ত আচরণ অনুসরণ করে চলেছে। রােজ পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্র ও সামরিক কর্মচারীদের আনা হচ্ছে। শাসকচক্র শুধু হত্যার শক্তি গড়ে তুলেই পরিতৃপ্ত হচ্ছে না,...“সুতরাং শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য দেশবাসীকে ডাক দেন নি, ইপিআর, পুলিশ, বাঙালি সৈন্যদের প্রতি যথাযথ আহ্বান জানান নি বলে আজও যারা তাঁর সমালােচনা করে চলেছেন এবং তিনি বুর্জোয়া বলে আপস করার মনােভাব নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন, কিংবা জনগণ সংগ্রাম করেছে, নেতারা আপস করেছেন বলে শেখ মুজিবের প্রতি কটাক্ষ করেন, তারা তাদের অতীতের মানসিকতা ত্যাগ করেন নি । আজ বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর ২০ বছর পার হলেও কেন হত্যার বিচার হয় না খেদোক্তির বদলে আমাদের অনেকের ভূমিকা কি ছিলাে আর কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে সে কথা বলার কি সময় এখনও আসেনি? কারণ ওই সময় প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের (আওয়ামী লীগ ব্যতীত) সাপ্তাহিকগুলােতে আলােচনা বৈঠক প্রসঙ্গে আপসের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি বলে শেখ মুজিবের প্রতি কটাক্ষ করা হয়নি। কিন্তু সেদিন উত্তাল জনজাগরণের মুখে তারা শ্ৰেণীচরিত্র ও বুর্জোয়া পার্টির সমালােচনার সঙ্গে সঙ্গে অসহযােগ আন্দোলনকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক শ্রেণীর পাকিস্তানি ভাবাদর্শে দীক্ষিত ব্যক্তি, যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে অবস্থান করছিল, তারা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিরােধিতার আড়ালে ভারতে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে থাকে। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের পক্ষে যুক্তি দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঁচানাের জন্যই এ ধরনের আপসের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন খােন্দকার মুশতাক আহম্মদ। আরও যারা ছিলেন তাদের মধ্যে মাহবুব আলম চাষী কয়েক বছর পূর্বে বিদেশে রহস্যজনকভাবে মারা যান। কেউ কেউ জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভা অলঙ্কৃত করেছেন। তাদের দু'একজন শেখ মুজিবের নাম উল্লেখের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বলেন বলে আমরা কখনাে কখনাে ভাবাবেগে বিহ্বল হয়ে পড়ি। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসারের এটা লক্ষণ বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করি। এরকম আরাে অনেক কর্মকাণ্ডে এই বাল্যখিল স্বভাবের উচ্ছাস ও দৌরাত্ম দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নব প্রজন্মকে দীক্ষিত করার জন্য, ঘাতক-দালালদের ভূমিকা নতুন প্রজন্মের নিকট তুলে ধরার জন্য আমাদের প্রাণান্ত আগ্রহের বিরাম নেই। কিন্তু সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামটা যেন না আসে তার জন্য সতর্কতার অন্ত নেই। কী জানি, তাহলে বোধহয় এসব সংগঠন কোন দলীয় কব্জায় তার স্বাতন্ত্র্য হারাতে পারে এই আশঙ্কা। বক্তৃতামঞ্চে ওঠে বলবেন, যে মহানায়কের জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতাে না, বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করা যায় না, অথচ কখনােই কাউকে বুঝতে পারবাে না যে, বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্পষ্টষ্ট হয় না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার আত্মাকে হারিয়ে ফেলে।
আর এ রকম পরিস্থিতি ও মানসিকতার পেছনে কাজ করছে গত ২০ বছর ধরে টেলিভিশনে ও রেডিওতে স্বাধীনতা দিবসে ও বিজয় দিবসে সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানকে তুলে না ধরার কারণে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কোথাও শেখ মুজিবকে যথাযথ স্থান না দেয়া কিংবা আদৌ তার নাম উল্লেখ না করা। এ রকম কর্মকাণ্ডের সমালােচনা আওয়ামী লীগ তথা তার অঙ্গসংগঠনের বাইরে অন্য কোন সংগঠনের লােক, যারা একদা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিলেন, তারা কখনাে করেন না। তারা শুধু মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকার কথাই বলেন। কার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সে কথাটা বাকচাতুর্যের আড়ালে চেপে যাওয়া হয়। আমরা আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ ও চেতনাকে নিজেদের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে মূল্য দেই না, সেখানে দলীয় স্বার্থকে বড় করে তুলি। কিন্তু তিনি যে জাতীয় নেতা, শুধু কোন একটি বিশেষ দলের শ্রেষ্ঠ আসনের তিনি অধিকারী নন, তার বাইরে বাঙালি জাতির চিত্তে তাঁর আসন আরাে অনেক বড়, সে কথাটা স্বীকারে আমরা কুষ্ঠিত। একজন বিদেশী ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়ন ছােট্ট একটি বাক্যে করেছিলেন, বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা।
জাতির জনক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বলে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিশেষায়িত করা হয়, তখন আমাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, অনেকে আপত্তি করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান স্বীকার করি, তবে তিনি জাতির জনক কেন বলবাে, বাঙালি জাতি তাে হাজার বছর ধরেই আছে, তার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনাে, জাতিতাে একদিনে গড়ে ওঠেনি, কী করে তিনি তার স্রষ্টা হলেন, তাঁকে স্বাধীনতার স্থপতিইবা কেন বলবাে, ও তাে তাঁর দলের লােকদের বাড়াবাড়ি। মুক্তবুদ্ধিচর্চার দোহাই দিয়ে, গণতন্ত্রে অবাধ মত প্রকাশের নজির দেখিয়ে আমরা কূটতর্কে মেতে উঠি। আর এই বিশ বছরে তাঁর হত্যার জন্য দায়ীদের সমালােচনা না করে শেখ মুজিব জাতিকে অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, ৭ মার্চেই বাঙালি সেনাদের বিদ্রোহ করার ডাক দেয়া তার উচিত ছিল এ ধরনের কথাবর্তা বলা হয়। আইন করে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচারকার্য যারা বন্ধ রেখেছেন, কখনাে তাদের ধিক্কার দেই না, তাদের সম্পর্কে কোন সমালােচনার কথা না বলে ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে সামরিক শাসক চক্র, তাদের বাম ও মধ্যপন্থী উপদেষ্টা ও মন্ত্র এবং নানাভাবে সহযােগিতাকারী শক্তির প্রচারাভিযানের সঙ্গে মাঝে মধ্যে আমরাও গলা মিলাতে কসুর করি না। গত ২০ বছরে এভাবে আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস রচিত হয়েছে মধ্যবিত্ত ধূর্তদের মুখ রক্ষার স্বার্থে- সে কথা স্বীকার করি না।
আজ সময় এসেছে নতুন প্রজন্মকে স্পষ্টষ্ট ভাষায় এ কথাটা জানিয়ে দেয়ার যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনে জয়ী হওয়া দুরূহ। বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের শিকড় হলাে বাংলাদেশের দীর্ঘ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অকুষ্ঠ স্বীকৃতি। তার হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দানকারী রাষ্ট্রশক্তির তথা '৭৫- পরবর্তী সরকারসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অবহিত করতে হবে। স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তির দ্বারদেশে দাড়িয়ে বলতে হবে, আমাদের নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের কারণে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিতে অপশক্তি সফল হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি জাতিকে তার রাষ্ট্রিক সর্বোচ্চ অধিকার স্বাধীনতা অর্জনেই নেতৃত্ব দেননি, তিনি মূঢ়তা থেকে, কুসংস্কার থেকে, বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দিয়েছেন, ধর্মের নামে যে বিভেদের শক্তি এই উপমহাদেশে পরশাসন দীর্ঘতর করেছে, যার জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও আমরা নতুন করে শৃঙ্খলাবদ্ধ হলাম, তিনি তাকে উপড়ে ফেলেছিলেন রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করে। রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে ইহলৌকিতা বা সেকুলারিজমই গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপের সন্ধান দেয়, সেই পরম সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উন্মার্গগামী বাম বুদ্ধিজীবীরা সেকুলারিজমের কথা বলেন বটে, কিন্তু শেখ মুজিব ভারতের পরামর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করেছেন বলে যখন বই লিখে আন্তর্জাতিকতাবাদের জয়গান করেন, তখন তারা যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সহচর সে কথা অকুণ্ঠিত চিত্তে বলতে হবে। আজ মৌলবাদী শক্তি এবং তাদের সমধর্মী সরকারি দল ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে ব্যাখ্যা করে। তার দায় তাদের একার নয়, সেই মিথ্যাচার তাদের নিজস্ব স্বভাবের একমাত্র অভিব্যক্তি নয়, আমাদের মধ্যে যারা শ্রেণী সংগ্রামের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের পরামর্শে আমদানি করা হয়েছে আর সমাজতন্ত্রে শেখ মুজিব বিশ্বাসী হলে গণতন্ত্র কথাটা অতিরিক্ত হিসেবে সংবিধানে স্থান দিতেন না বলে মন্তব্য করেছেন, তাদের সতর্ক হতে হবে। তারাই রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থে সন্ত্রাসীদের সহায়তা নিয়েছেন গত নির্বাচনে এবং একই সঙ্গে সংগােপনে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছেন। স্বাধীনতা দিবসের পঁচিশ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে পেছনের এই অতীত কর্মকাণ্ড বিস্মৃত হলে আমাদের আবারাে প্রবঞ্চিত হতে হবে। বাঙালি জাতির সংস্কৃতির মধ্যেই সেকুলারিজমের মর্মবাণী ধ্বনিত হয়েছে, যেখানে চণ্ডীদাস বলেছেন 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই । ড. ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, চণ্ডীদাসের পর এমন মানবতাবাদী কবি বাংলাদেশে আর জন্মগ্রহণ করেন নি। তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলতে পারি, সেকুলারিজমের একজন সত্যদ্রষ্টা রাজনীতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতাে আর কোন দেশনায়ক এদেশে আবির্ভূত হননি। শুধু পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র যদি তিনি লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে, যা শুধু সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবেই নয়, তাঁর আদর্শ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতেন, ইতিহাসে তিনি মহানায়কের স্থান, শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্থান পেতেন না, স্বাধীনতাবিরােধী বিভীষণ চক্রের হাতে নিহতও হতেন না। আজ তিনি ঘাতকের চক্রান্তে নিহত হয়েও বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব এক মৃত্যুঞ্জয়ী স্থান দখল করেছেন। তার আদর্শের বাংলাদেশের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে তার স্থান সেখানে অমর। কেউ সে স্থান থেকে তাকে কখনও সরাতে পারবে না। আর এজন্য বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ শব্দ দুটি একত্র হয়ে গেছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তিনি একটি সংক্ষিপ্ত নামে সর্বত্র পরিচিত। তা হলাে 'বঙ্গবন্ধু'। কোন অহমিকাপ্রসূত দম্ভ, কোন সংকীর্ণ বুদ্ধির ধূম্রউদগীরণ, কোন অহঙ্কারের দীনতা, পাণ্ডিত্যের মৃঢ়তার আস্ফালন এই নামটিকে জাতির হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। ১৯৭১ সালে সেই উন্মাতাল অসহযােগ আন্দোলনের সময় নিজের জন্মদিন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার আবার জন্মদিন কী? আমার জীবন জনগণের জন্য নিবেদিত। আমি যে তাদেরই লােক।” তাই জনগণের হৃদয়ে জনগণের ভালবাসায় তার অমরত্ব স্বাক্ষরিত।
সূত্রঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মাদ হাননান