দেশের নামটি বাংলাদেশ, কে রেখেছিলেন এই নাম

14956

Published on ফেব্রুয়ারি 14, 2021
  • Details Image

মোহাম্মদ হাননান:

বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু এদেশের স্রষ্টাই ছিলেন না, দেশটির নামও তিনি রেখেছিলেন। আর এই জন্যই তিনি 'জাতির পিতা শিরোনামে অভিষিক্ত হন। শত সংগ্রাম, জেল, জুলুম, ফাসির কাষ্ঠ- সবকিছু তুচ্ছ করে তিনি বাঙালি জাতির শত বছরের স্বপ্নের দেশ 'বাংলাদেশ’-কে সত্যে পরিণত করে তোলেন।

অনেক পিতা-মাতা তাদের সন্তান জন্ম হওয়ার আগেই সন্তানের নাম রেখে দেন। বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম হওয়ারও অনেক আগেই এই মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশের নামটি রেখেছিলেন।

১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের বৈঠক চলছিল করাচিতে। ২৫ আগস্ট হঠাৎ করেই সংসদে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভরাকণ্ঠে স্পিকারকে বললেন-

“স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা 'পূর্ববাংলা' নামের পরিবর্তে 'পূর্ব পাকিস্তান' নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার বলেছি, আপনারা এদেশটিকে 'বাংলা' নামে ডাকেন। 'বাংলা' শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম পরিবর্তন করতে চাইলে আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে,

Sir (Speaker), you will see that they want to place the word 'East Pakistan' instead of 'East Bengal'. Bengal has a history, has a tradition of its own. (Sheikh Mujib in Parliament (1955-58), Edited by Shahryar Iqbal, Agamee Prakashani, 1997, P.10)”

ভাবতে অবাক লাগে, সেদিন ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও কী অসম সাহসে শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের মুখের ওপর এই বাংলা শব্দ বলে এসেছিলেন। সেদিন 'বাংলা' আর 'বাঙালি শব্দ বলতে হলে শুধু সাহস থাকলেই হতো না, দুঃসাহসও প্রয়োজন হতো। দেশটির নাম 'বাংলা' এ কথা তিনি ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সরকারি দলিলে এভাবেই লিখে রেখেছিলেন ।

তারপর ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধু গেলেন পাকিস্তানের করাচি নয়, পিন্ডি নয়, এমনকি ইসলামাবাদও নয়, একেবারে রাজনৈতিক শহর লাহোরে। এখানে তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন ৬-দফা। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ছিল যেন অনেকটা ৬টি অ্যাটম বোমা। এই ৬-দফার ৬-বোমার আঘাতই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটায়। ৬-দফা ঘোষণা করে ১৩ এপ্রিল লাহোর থেকে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফেরেন। ৬-দফা আওয়ামী লীগের সেদিনের অনেক বুড়ো নেতাই মানতে পারেননি। ফলে এদিন বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের তরুণ নেতাদের গোপনে ডাকেন এবং ৬-দফার আসল অর্থ বুঝিয়ে বলেন। বঙ্গবন্ধু এদিন ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে বলেন, যদি একদিন এ দেশ স্বাধীন হয়, তাহলে এ দেশের নাম হবে বাংলাদেশ।

এরপর ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বলে যে, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে ফেলতে চায় । আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে মামলা দাঁড় করানো হয় তাতে কতকগুলো প্রমাণপত্র পাকিস্তান সরকার হাজির করে। এই প্রমাণপত্রগুলোতে দেখা যায়, কতকগুলো ছদ্মনামে লেখা চিঠি এবং একটি টুকরো কাগজে বাংলাদেশ লেখা একটি নাম রয়েছে।

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ।

১৯৭০ সালের জুন মাসে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে তোলা জয়বাংলা বাহিনী পল্টন ময়দানে (বর্তমানে ঢাকার আউটার স্টেডিয়াম) কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু এদিন জয়বাংলা বাহিনীর নেতা আ স ম আবদুর রবের হাতে একটি পতাকা তুলে দেন। আ স ম রব মার্চপাস্ট সালাম জানিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে পতাকাটি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এটাই বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে ঘটে এক মহা ঘটনা। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের নির্বাচনে বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা এদিন শপথ গ্রহণ করে লাখাে মানুষের সামনে। এদিন অনুষ্ঠান শুরু হয় আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশটা যদি কোনোদিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। বঙ্গবন্ধু এদিন আরেকটি ঘটনা করে বসেন। তিনি তার ভাষণের শেষে স্লোগান দেন, আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।

দেশটির নাম কীভাবে বাংলাদেশ হলো, এ চূড়ান্ত ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। এদিন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে এই সভায় বক্তৃতা করেন। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে এদিনের ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়:

স্বাধীন সার্বভৌম 'বাংলাদেশ’ ঘোষণা করা হয়েছে ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে। স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। (১৯৭১ সালের ৪ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক, আজাদ এবং সংবাদ)।

আগামী দিনের গবেষক ও পাঠকরা এই বিষয়ে আরো অনুসন্ধান করতে পারবেন কীভাবে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা নামের দেশটির নামকরণ করেছিলেন। বাঙালি জাতির ইতিহাস রচনায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্রঃ শ্রেষ্ঠ বাঙালি, সম্পাদনাঃ মোনায়েম সরকার এবং মোহাম্মাদ হাননান

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত