মানবমুক্তির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু

1932

Published on মার্চ 12, 2020
  • Details Image

গোলাম কবিরঃ

মাতৃদুগ্ধসম’ মাতৃভাষায় মানুষের অধিকার যেমন সহজাত ‘স্বর্গদপি গরীয়সী’ মাতৃভূমিতে স্বচ্ছন্দে বসবাসের আধিকার অবদমিত ও অপহৃত হয়েছিল নানা কারণে। ইতিহাস যার সাক্ষ্য বহন করছে। বাংলা ভাষার মুক্তির সহযাত্রীদের অন্যতম হয়ে এবং স্বদেশমুক্তির পুরোধাজনকরূপে যাঁর অবদান অবিসংবাদিত, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর এই অতুল অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পণ্ডিতবর ড. এনামুল হক প্রথম দ্বিধাহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু বাঙালি শ্রেষ্ঠ। এই প্রত্যয়টি তখনকার দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছিল। আমরা ভাগ্যবান, এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জন্মশতবর্ষের শুভক্ষণ উদ্যাপনের সুযোগ পেলাম।

ঢাকা শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দূরে নদীপথ ছাড়া প্রায় যোগাযোগবিহীন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আর পাঁচটি বাঙালি সন্তানের মতো জন্মেছিলেন খোকা নামের শিশুটি। গ্রামীণ জনপদের সব শ্রেণির মানুষের সংস্পর্শে এসে মানবিক মূল্যবোধ এবং মানবচরিত্র অধ্যয়ন করেছিলেন সেই শিশু-কিশোর-তরুণ বঙ্গবন্ধু। সেখান থেকেই তিনি পর্যায়ক্রমে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে উঠলেন। মুক্ত মানবসমাজ গড়ার স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন-যোজনা দূর কল্পনাপ্রসূত বলে মনে হলেও, শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ববাসীকেও দেখিয়ে দিয়ে গেছেন, আপন অফুরান-দৃঢ়তা দিয়ে। আমরা তাঁর গর্বিত উত্তরাধিকার।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতপার্থক্য হয়েছে, তবে আত্মসমর্পণ করেননি। শেখ মুজিবের বক্তব্যের যৌক্তিকতা অনুধাবন করে সোহরাওয়ার্দী তাঁকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়েছেন। অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে তার চমৎকার বর্ণনা আছে। কলকাতায় কলেজ হোস্টেলে অবস্থানের সময় দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ আর জাতি-বিদ্বেষ ভয়ংকর রূপ ধারণ করলে তিনি জীবন বাজি রেখে আর্তমানবতা রক্ষার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। সৎ কর্মযোগী তরুণের কর্মযজ্ঞের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তখনকার ওই কলেজের শিক্ষক এবং হোস্টেল সুপার প্রফেসর সাইদুর রহমান অকপটে তাঁর প্রশংসা করেন। ‘শতাব্দীর সাক্ষী’ গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ আছে। স্মর্তব্য, পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির পর স্বৈরাচার আমলে তিনি স্মৃতিচারণার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ বাঙালির পরিচয় তুলে ধরেন। ইতিহাসের সত্যকে কালের পৃষ্ঠায় ধরে রাখার জন্যই দার্শনিক সাইদুর রহমান কলম ধরেছিলেন।

সাতচল্লিশে ভ্রান্তিবিলাসের দেশভাগের পর ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু মানুষের মৌলিক দুটি অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন। একটি মাতৃভাষা, অন্যটি স্বল্প বেতনভুক্তদের বাঁচার অধিকার। ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর অবদান হয়তো ইচ্ছাকৃত ‘ব্লাকআউট’ করা হয়েছে, তবে ইতিহাস পরম্পরা বলছে, তিনি কারাগারে অবস্থান করেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি থেকে একচুলও সরে যাননি। তিনি বুঝে ছিলেন মাতৃভাষা সমাজ ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হলে সব আয়োজন নিষ্ফল হয়ে যাবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পরিচালনার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৫ই আগস্ট জাতীয় ট্র্যাজেডির পর সব বানচাল হয়ে যায়।

কলকাতা পর্বের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বাঁচামরার দাবি আদায়ের সংগ্রামে তিনি পিছপা হননি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি অন্যায়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে জনমানুষের দাবিকে উপেক্ষা করেননি।

জীবনের অর্ধেকটা সময় তিনি কারাগারে অন্তরীণ থেকেছেন জাতির মুক্তির জন্য। পাকিস্তানিচক্র আগরতলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে জগৎ থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হলেও বাঙালির জীবন-মরণ প্রতিরোধে তিনি মুক্ত হন এবং বাংলার মানুষের প্রকৃত বন্ধু ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন। সত্তরের নির্বাচনে স্মরণকালের ইতিহাসে বাঙালি তাঁর পক্ষে উজাড় করে সমর্থন দেয়। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা না দিয়ে একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকায় ঘুমন্ত মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তাঁর অবর্তমানে শুধু তাঁর নামের মহিমায় ভর করে বাঙালি অসমশক্তিশালী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করে। বন্দি হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। বাংলাদেশের কিছু কৃতঘ্ন পাকিস্তানপ্রেমী তা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি কম করেনি। তারা একজনকে ঘোষক বানিয়ে ফেলে। গোপনে গোপনে কাজ করে যাওয়া ইতিহাস সগৌরবে ঘোষণা করছে, শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের জন্ম দিয়ে বাঙালির স্বপ্নকে বাস্তবতাদানের রূপকার।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। তখনো বাতাসে লাশের গন্ধ। উঠলেন অরক্ষিত ৩২ নম্বর, অরক্ষিত নিজস্ব বাসভবনে। খলিফা ওমর যেমন নজরুলের ভাষায় ‘খেজুর পাতার প্রাসাদে’ অবস্থান করতেন, ক্যাস্ট্রো যেমন জনগণের সুরক্ষার আগে বিলাসময় প্রাসাদে যাননি, বঙ্গবন্ধুও তেমনি ছিলেন দৃষ্টান্ত। তাঁর সব জীবনের একাগ্র সাধনা ছিল বাংলার দুঃখী মানুষকে সুখী করার। তাই তিনি সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ গৃহে বসবাস করে শূন্য ভাঁড়ার নিয়ে দেশকে সবার জন্য বসবাসের যোগ্য করার ব্রতে নিরত হন এবং বিশ্ববিবেকের স্বীকৃতি আদায় করেন।

পঁচাত্তরের নৃশংস ট্র্যাজেডির আগে মাত্র সাড়ে তিন বছরে মানবমুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা বাংলার ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। আগেই বলা হয়েছে, তিনি মাতৃভাষা বাংলা সর্বজনীনতা দান করেন। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও বাংলা ভাষার যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে জাতিসংঘের দরবারে সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দেন। দয়ার বেড়ি থেকে মুক্ত করে শিক্ষা যে মানুষের মৌলিক অধিকার তা পূর্ণ করার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের নির্দেশ দেন। দেশপ্রেম কত গভীর হলে প্রায় শূন্য হাতে বৃহৎ পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা এ দেশের মানুষের কাছে অকল্পনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধু তা করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা ছিল অতুলনীয়। রাজশাহী কলেজের কৃতী ছাত্র মনোয়ারুল ইসলাম তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সান্নিধ্যে থাকার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, অপরাধীর বিচারের বিষয়ে আগে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভাবতেন। মানবিক ভুল এবং শয়তানি ভুল তিনি বোঝার চেষ্টা করতেন এবং তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতেন।

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমকারী বিভ্রান্তরা, পাকিস্তানি সেবাদাসবৃন্দ আর হঠাৎ ধনী হয়ে উঠতে চাওয়া দুর্বৃত্তরা তাঁকে স্বস্তি দেয়নি। মানবমুক্তির জন্য তাঁর সংগ্রামের ফসলকে লুণ্ঠিত করতে উদ্যত হয়। বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার কৌশল পরিবর্তন করে তা জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। লেখা বাহুল্য, মানবমুক্তির এই ভাবনা হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠেনি। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে দেখা যাবে তখনকার চীনের বেয়াড়া প্রকৃতিকে শিকলবদ্ধ করে মানুষের কল্যাণে নিয়ে আসায় তিনি কতটা বিমুগ্ধ। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার দানের প্রতি তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। তাই বলে গণতন্ত্রের নামে দলের ফাঁদ পেতে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রবণতাকে তিনি শুভান্তিক ভাবতেন না। তিনি মনে করতেন, দেশ ও দেশের মানুষকে যারা ভালোবাসে তারা নিজেদের কর্মযজ্ঞ দিয়ে নেতৃত্বদানের প্রমাণ দেবে। বিদেশি মতবাদসংবলিত প্রক্রিয়ার পরিবর্তে চিরপুরনো অথচ নতুন আঙ্গিকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিষয়াদিকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। মানুষ তাদের প্রিয় ব্যক্তিকে বেছে নেবে, যারা বিপদে পাশে থাকবে। তখনকার দিনে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা তরুণ অফিসার ফরাস উদ্দিন এর যথাযথ পরিচয় তুলে ধরেছেন। যদিও তা সংক্ষিপ্ত।

কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভরসার স্থল ছিল। তারাই তো দেশের সিংহ ভাগ জনগণ। তাদের প্রাধান্য দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে কৃষক-শ্রমিক অভিধাটি স্পষ্ট করেন। কায়েমি স্বার্থবাদীরা গণতন্ত্র গেল বলে তারস্বরে শোরগোল তুলল। এখনো একই কথা বলে বাজিমাত করতে চায়।

মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে কখনো বঙ্গবন্ধু ভাঁওতার আশ্রয় নেননি। শূন্য রাজকোষ আর বৈরী পরিবেশ কাটিয়ে উঠার জন্য মিথ্যা আশ্বাস না দিয়ে তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, তিন বছর কিছুই দিতে পারবেন না। ইতিহাস বলছে, আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা উচ্ছেদের সদিচ্ছা থেকে সরে দাঁড়ানোর ভান করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চাননি। তাঁকে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সততার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে ভালোবাসার আন্তরিক আয়োজন করেছিলেন : ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো ওই একই রকম বয়সে জঘন্য পদ্ধতিতে সরিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে।

বঙ্গবন্ধু যে অকপট মানবপ্রেমী ছিলেন, তার অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে কুমিল্লা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর প্রথম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডেটদের সামনে রেখে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে তাঁর বাঙালি জননীর মতো সন্তানদের ভালোবাসা এবং বিশ্বজনীন মানবমুক্তির বাণী প্রাধান্য পেয়েছে। বলেছিলেন, যুগযুগ ধরে প্রবঞ্চিত বাংলার মানুষের বিপদের সময় যেন তারা কাছে থাকে এবং সহকর্মী হয়ে তাদের মুখের দিকে চায়। ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডির পর অনেকে ব্যক্তিস্বার্থের জন্য বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্যকে খর্ব করতে চেয়ে ঘাতকবন্ধনায় মুখর হয়েছিল।

মহাকাল মিথ্যা আবর্জনা দীর্ঘ সময় বহন করে না, আমরা তাই সে পথে যাব না। আমরা বঙ্গবন্ধুকে মানুষের সুখ-দুঃখের দোসর মনে করি। সমগ্র জীবন তিনি দুঃখী মানুষের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখার জন্য প্রাণপাত করেছেন। তাঁর আরব্ধ কর্মপন্থা অবলম্বন করলে মানবজন্মের সার্থকতার সন্ধান মিলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। উত্পীড়িত শোষিত মানুষের তিনি গোত্রভুক্ত থাকতে শ্লাঘাবোধ করতেন। বিশ্বসভায় তা ঘোষণাও করেছিলেন। একাত্তরের ৭ই মার্চ আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বেন। তাঁরা বিশ্বাসের বিন্দুতে পৌঁছাতে আমরা কতটুকু সফলকাম হতে পেরেছি, সে সত্য ভেবে অগ্রসর হতে পারলে মানবমুক্তির কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের যথার্থতা খুঁজে পাব এবং তাঁকে সত্যিকার সম্মান দেওয়া হবে।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

প্রকাশঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত