953
Published on জুলাই 31, 2022আজকের আধুনিক বাংলাদেশে প্রমত্তা পদ্মার ওপর ওপর যে স্বপ্নের সেতু নির্মিত হয়েছে, জাতির নিজস্ব অর্থায়নে যে সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছে বাংলাদেশ, সেই পদ্মাসেতুর কারণে আন্তর্জাতিকভাবেও বাঙালি জাতিকে আজ সন্মানের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে শতকরা এক শতাংশের বেশি জাতীয় আয় বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল যেভাবে এতোদিন দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল, সেই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে এই সেতুর কারণে এখন সড়কপথেও একসূতোয় বাঁধা পড়লো পুরো দেশ। এই সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব যেমন শিল্পায়ন গড়তে সহায়তা করবে, তেমনি মধ্যম ও নিম্ন আয়ের কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির কারণও হতে যাচ্ছে এই সেতু। এটাই তো বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, যেখানে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটবে।
জাতির পিতা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বহুমুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেও দেশকে গড়ে তুলছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরকম একটি সময়ে সপরিবারের জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টাকে বর্ববরভাবে হত্যঅর মাধ্যমে দেশকে আবারো অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয় উগ্রবাদী ও স্বৈরচার চক্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর উদ্যোগ নেন। ফলে অল্প সময়ের সধ্যেই খাদ্যঘাটতির প্রতিবন্ধকতা জয় করে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় বাংলাদেশ। ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ার ব্রত নিয়ে এখনও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারের গত এক যুগের ধারাবাহিকতায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন খাত সৃষ্টি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এছাড়াও স্বৈরশাসন ও বিএনপি-জামায়াতের আমলের গুণ্ডামির রাজনীতি থেকে ইতোমধ্যে দেশকে বের করে এনেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বৃহত্তর জেলাগুলোতে স্থাপন করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী তথা ঘরবন্দি নারীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে অবাধ কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে তাদের। ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর ও সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে শিশু ও মায়েদের জন্য সুরক্ষামূলক কর্মসূচি। গত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখবেন- নারী, বিধবা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এতিম, হতদরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থী সবার জন্যই সুরক্ষা নিশ্চিতে বিশেষ বরাদ্দ রাখলে শেখ হাসিনার সরকার। বঙ্গবন্ধু যেভাবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে জাতিকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঠিক সেভাবেই তা বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা দেশকে হাতের মুঠোয় আনার পর, সড়ক পথেও পুরো দেশকে একসূত্রে আনা হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি লাখ লাখ ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকেও সরকারি উদ্যোগে তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে আবাসন। ঘরে বসেই ভাতা পাচ্ছেন কোটি মানুষ। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেড় কোটি মানুষকে নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল। সেই ধারাবাহিকতাতেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাস্তবায়ন করা হচ্ছে একের পর এক মেগা প্রকল্প। এরকমই একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক আজকের পদ্মাসেতু। শেখ হাসিনার উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন বাস্তবায়নেরই ফসল।
অথচ ১৯৭৫ সালের পর প্রায় দুই দশক থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে ফেরার চেষ্টা করেছিল দুর্বৃত্তরা। তবে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে- ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। সত্য কখনো চাপা থাকে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলে যে বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করতো পশ্চিমারা, আজকে সেই বাংলাদেশের সাহস, স্পৃহা, উন্নয়ন এবং বদলে যাওয়া দেখে তারাই স্যালুট করতে বাধ্য হয়েছে। আজকের এই বাংলাদেশের পরিকল্পনা নতুন কিছুই নয়, বরং কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন, সেসবের বাস্তবায়নের ফলই আজকের বাংলাদেশ। এটি এখন দেশের বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, নীতিপ্রণেতারা যেমন উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করছেন; তেমনি বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোও তা স্বীকার করছে।
যে বঙ্গবন্ধুর নিলে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন করতো দেশবিরোধী শোষক চক্র, তাদের মুখে চপেটাঘাট দিয়ে আপামর বাঙালির ভোটেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বব্যাপী বড় বড় নেতারা তাকে অভিহিত করছেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে, বঙ্গবন্ধুকে তারা অভিহিত করেন মহান নেতা হিসেবে, বিশ্ববন্ধু হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনের ভিত্তি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা যেসব মন্তব্য করেছেন- বিবিসি তাদের প্রচারে ঐসব বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য তুলে ধরেছেন। বিবিসির সেই প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখছেন আধুনিক প্রজন্ম। তারা মনে করেন: ‘আজ আমরা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যে যেখানেই বসে যা কিছু করছি- যা বলছি- তার কোনটাই সম্ভব হতো না, যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে না পেতাম। তিনিই বাঙালি জাতিকে প্রথম বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সর্বোপরি বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। মৃত্যুভয় বা ক্ষমতার লোভ কোনও কিছুই তার দীর্ঘ সংগ্রামী মনোভাবকে দমিয়ে দিতে পারেনি। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রণী এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপায়ণ করেন। তার ৭ মার্চের ভাষণ মন্ত্রের মতো সমগ্র বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর একটি সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াইয়ে নামতে এবং সেই লড়াইয়ে জিততে উদ্বুদ্ধ করেছিল।’
বিবিসি জরিপের সেই প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি: ঢাকা থেকে শহিদুল হক ‘মুজিবের ৭ মার্চের কন্ঠস্বরকে ঐশী কন্ঠস্বর’ বলেছেন এবং তার ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সাত কোটি মানুষকে ঐদিন একসূত্রে গেঁথেছিলেন। এই একই সূত্রে গাঁথা ‘মানুষগুলোর পরিচয় না মুসলমান, না হিন্দু, না বৌদ্ধ, না খ্রিস্টান- তারা সবাই ছিলেন বাঙালি।’
বৃটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিনাত হুদা আরও বলেন, 'বাঙালি জাতির স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম আর সফলতার রূপকার হচ্ছেন শেখ মুজিব। এই জাতির ভিত্তি হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি। মুজিব তার অসাধারন নেতৃত্বে আবহমান শাশ্বত বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেন ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। মুজিব, তাঁর অসাধারন প্রজ্ঞা, মেধা, ত্যাগ, অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এই (স্বপ্ন) আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করেছেন।’
খ্যাতিমান প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি তার নেতৃত্বের তিনটি বড় গুণ দেখি। প্রথমত, তিনি অত্যন্ত সাহসী ছিলেন, দৃঢ়চেতা ছিলেন এবং আপোষহীন ছিলেন, যার অভাব আমরা আমাদের দেশের নেতৃত্বে বারবার দেখেছি। অন্যরা আপস করে ফেলেন, ক্লান্ত হয়ে যান এবং ঐভাবে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যান না। দ্বিতীয়ত, যে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখেছি তার নেতৃত্বে সেটা হলো এই যে, তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রধান দ্বদ্ব কী- সেটাকে খুব সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তৃতীয়ত হচ্ছে যে, ব্যক্তি হিসেবে তার মধ্যে অসাধারন গুণ ছিল, তার আকর্ষণী শক্তি ছিল যাকে ক্যারিশমা বলে, তিনি জনগণকে বুঝতেন, জনগণের সঙ্গে মিশতে পারতেন, তাদের ভাষা জানতেন, তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। কাজেই আমরা তার মধ্যে দেখবো যে- তার মধ্যে বীরত্ব ছিল এবং নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা ছিল, যার একটা সমন্বয় ঘটেছিল তার মধ্যে।'
দলমত নির্বিশেষে আপামর বাঙালি তাদের মতামতে বলেন, ‘১৯৪৭ সালে অখন্ড ভারত বিভক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়নি। ভারত বিভক্তির পর বাঙালিকে আবারো নতুন করে পরাধীনতার জিঞ্জির পরতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, যিনি শুধু বাঙালিদের মনে ও চেতনায় স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিলে তিলে তিলোত্তমা গড়ার সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তদুপরি তিনি এমন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন যার পরিচিতি ভৌগোলিক সীমারেখায় শুধু আবদ্ধ নয়; তার আদর্শিক ভিত্তি হচ্ছে মানবিক, গণতান্ত্রিক সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।’
হ্যাঁ, ঠিক তাই। এবজন সচেতন বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর লেখা বই 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', 'কারাগারের রোজনামচা', আমার দেখা নয়া চীন' গ্রন্থগুলো পড়ুন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বিভিন্ন ভাষণগুলোর সংকলিত গ্রন্থ পাওয়া যায়, সেগুলো পাঠ করুন। শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে গেলে, বাঙালি জাতির আদর্শ ও সংগ্রামের শক্তির মূলভিত্তিগুলো বুঝতে হলে আমাদের সবারই একটু লেখাপড়া করা উচিত। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, হয়তো বঙ্গবন্ধুকন্যার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কারণে বাংলাদেশ একদিন উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে- কিন্তু সেদিন আপনি যদি আপনার নিজের পূর্বপুরুষদের ত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস বলতেনা পারেন, শুধু আর্থিক মুক্তি আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তি দেবে না। সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ গড়তে চাইলে, শেকড়ে ফিরুন; তাহলে একদিন শিখরে উত্তীর্ণ হবেন।