বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

4101

Published on জানুয়ারি 19, 2021
  • Details Image

বেবী মওদুদঃ

১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলের গোপালগঞ্জ থানার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পূর্বপুরুষরা বাগদাদ থেকে এসে প্রথমে বসতি গড়েন চট্টগ্রাম শহরে। কেননা বণিক হিসেবে তাঁদের পরিচিতি ছিল। পরবর্তীকালে দক্ষিণবঙ্গের জলাভূমিতে কৃষিজাত ফসল উৎপাদন সুবিধাজনক মনে করে তাঁরা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন। ১৮৫৪ সালে সেই দিল্লি থেকে কারিগর এনে টুঙ্গিপাড়ায় শৌখিন দালানবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান রয়েছে। এই শেখ-বংশের প্রধান পেশা ছিল কৃষি-উৎপাদন ও ব্যবসা। তাঁরা ঐ সময়ে কোলকাতা, বোম্বাই প্রভৃতি শহরে খাদ্যশস্যের ব্যবসা করতেন। তাঁদের জমিদার ছিলেন রানী রাসমণি।

শেখ-বংশের জীবন-আচরণ অত্যন্ত সরল-সাধারণ ছিল। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও ফারসি বাংলা ইংরেজি চর্চা ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য। সামাজিকভাবে নেতৃত্বদান এবং জনগণের মাঝে বসবাস করে তাদের কল্যাণমুখী উন্নয়ন সাধন করা। শেখবাড়ির কৃষিজমিতে যেসব কৃষক কাজ করত তারা অধিকাংশই হিন্দু ও নিম্নবর্ণের হলেও শেখ-বংশের উদার মানবিক হৃদয়ের কারণে তারা সন্তানতুল্য হিসেবে পরিচিত হতেন। এখানকার কৃষি-ফসল উন্নত ছিল, দুধ-মাখন সবই কোলকাতায় দিনে দিনেও পাঠানো সম্ভব ছিল। আবার খুলনা-যশোর-বেনাপল ট্রেন-যাতায়াতও ছিল সুবিধাজনক। তবে নৌপথই ছিল একমাত্র পরিবহন। পাটগাতিতে প্রতি সপ্তাহে বিরাট হাট বসত। আশপাশের সব গ্রামের উৎপন্ন ফসল এখানে আসত। পাটগাতি নদীর ঘাটে বড় বড় নৌকা এসে ভিড় জমাত। এই হাটের পরিচিতি এত বিস্তৃত ছিল যে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী বণিকরাও এসে কেনাকাটা করতেন।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক সম্পদ রয়েছে এই টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব জীবনের ভিত গড়ে তুলে পরিপুষ্ট করে এই প্রকৃতি। গ্রামের বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষকের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা হয়। এছাড়া ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস, অঙ্ক পড়ানোরও গৃহশিক্ষক ছিলেন। আত্মীয়-অনাত্মীয়-আশ্রিত প্রায় তেরো-চৌদ্দ জন ভাইবোন তারা একত্রে মানূষ হয়েছিলেন।

শেখ মুজিবের ডাক নাম মজিবুর, মা-বাবা ডাকতেন খোকা বলে, অন্যান্যরা মিয়াভাই বলে। বাড়ির গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া মাত্র চারবছর বয়স থেকে শুরু হয়। সাতবছর বয়সে তিনি বাড়ির কাছে নিমাডাঙ্গা স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পিতা শেখ লুৎফর পেশকার হিসেবে রাজবাড়ি, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ কোর্টে চাকরি করতেন। ছুটিতে তিনি বাড়ি এলে খোকা তাঁর কাছছাড়া হতেন না, শহরের গল্প শুনতেন। শৈশব থেকেই খোকা গ্রামের মাঠে সঙ্গীসাথী নিয়ে ফুটবল খেলতেন, সাঁতার কাটতেন, ঘুড়ি ওড়াতেন, মাছ ধরতেন। গ্রামীণজীবনের সব মাধুর্য শৈশব-কৈশোর থেকে তাঁকে এক সারল্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে বিশেষ সাহায্য করে। শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুর কোর্টে চাকরি করতেন। পরে তিনি গোপালগঞ্জ শহরে এসে বসবাস করেন। তখন শেখ মুজিব প্রথমে গোপালগঞ্জ স্কুলে এবং পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন। শহরের ব্যাংকপাড়ায় ছিল তাঁদের বাড়ি, যা এখনও রয়েছে। এই স্কুলে পড়ার সময় তাঁর চোখের চিকিৎসার জন্য তিনি পিতার সঙ্গে কোলকাতা যান। সেই তাঁর প্রথম কোলকাতা-ভ্রমণ। চোখের অপারেশনের কারণে প্রায় চার বছর পড়াশুনা বন্ধ থাকে। এরপর তিনি আবার নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত করেন। ঐ সময়ে তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন হামিদ মাস্টার-যিনি গান্ধিজির ভক্ত ছিলেন, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার সঙ্গে জড়িতও ছিলেন। - তাঁর কাছেই শেখ মুজিবুর রাজনীতির কথা শুনতেন।

গোপালগঞ্জ শহরও ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তৎপর। ব্রিটিশ শাসকদের ঘোড়সওয়ার ইংরেজি সেপাইরাও টহল দিয়ে বেড়াত।
স্কুলে যখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র, একবার অবিভক্ত বাংলার গভর্নর শের বাংলা ফজলুল হক এসেছিলেন। স্কুলে হোস্টেলের ছাদ থেকে পানি পড়া বন্ধ করার দাবি জানিয়ে তিনি স্কুলছাত্রদের নিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে ফজলুল হক মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঐ আমলের এন্ট্রান্স পাস করার পর শেখ মুজিবুর কোলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন।

স্কুলজীবন থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। এরপর কোলকাতায় গিয়ে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। কোলকাতায় হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনেও জড়িত হন। ঐ সময়ে তিনি ফজলুল হকের সংস্পর্শ ছাড়াও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় জড়িত হন।

১৯৪৭ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ঢাকায় ফিরে তিনি যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় ভাষার প্রশ্নে ঢাকার ছাত্রসমাজ আন্দোলন গড়ে তোলে। শেখ মুজিবও এ-আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ঐ সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারীদের নেতাও ছিলেন। ভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট চলাকালে পিকেটিং করার সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৫ মার্চ মুক্তিলাভ করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করায় তাঁকে জরিমানা ও বহিষ্কার করেছিল।

১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি একটি ভুখামিছিলে নেতৃত্ব দান করায় তাঁকে গ্রেফতার করে দুবছর জেলে রাখা হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন চলাকালে তিনি একটানা ১৭ দিন অনশন ধর্মঘট করেন। ঐ সময়ে তাঁর নির্দেশে ছাত্রলীগ কর্মীরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। অনশনের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হলে তাঁকে ফরিদপুরে নেওয়া হয় এবং তিনি সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন, মওলানা ভাসানী সভাপতি ছিলেন।

১৯৫৪ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। এ সময় যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের ২২৩টিতে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগে পায় ১৪৩টি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবের সাংগঠনিক তৎপরতায় ছিল তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক সচেতনতা। ফলে তিনি সংগঠনকে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হন। বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আপোসহীন নিরন্তর আন্দোলন গড়ে তোলেন। একদিকে রাজপথ-জনপদে মিছিল-সমাবেশ সংগঠিত করে জনগণকে অধিকার সচেতনে উজ্জীবিত করে তোলেন, অপরদিকে করাচিতে গণপরিষদে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে বাংলার মানুষের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘পূর্ব বাংলা’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখলে তিনি কঠোর সমালোচনা করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবি করেন এবং বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি উত্থাপন করলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের প্রতি’যে বঞ্চনা ও শোষণের স্টিমরোলার চালাচ্ছিল, ৬-দফা ছিল তার বিরুদ্ধে এক সাহসী সংগ্রাম। ৬-দফা দাবি পরবর্তীকালে ছাত্র-আন্দোলনের ঐতিহাসিক ১১-দফা দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। শেখ মুজিবকে কুখ্যাত আগরতলা মামলায় জড়িয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার চালানো হয়। কিন্তু ছাত্র-আন্দোলনের রোষানলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হন এবং মামলাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি সংবর্ধনায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ঘোষণা করা হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিও করেছিলেন। এরপর আইয়ুব শাহির পতন হয়, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসে।

এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা না-দেয়া এবং তার পরিণতিতে আসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় অর্জন, পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর আটক ও বিচার, মৃত্যুদণ্ড প্রদান, ১৯৭২-এর মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রত্যাহার, মুক্তিদান ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তারপর তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসী তৎপরতা দমন, জাতীয় ঐক্য গঠন, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ।

১৯৭৫ সালে একটি জাতীয় দল গঠন করে সকল রাজনৈতিক ও পেশাজীবীর অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে যখন তিনি স্থিতিশীল অবস্থায় দেশকে নিয়ে এলেন এবং জনগণের মাঝে প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, দ্রব্যমূল্য কমতে শুরু করেছে, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ও ১৬ জন আত্মীয়স্বজনসহ সেনাবাহিনীর উচ্চাকাঙ্ক্ষী একদল অফিসার হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দেশকে ১৮ বছর ধরে স্বৈরশাসনের নিয়ন্ত্রণে রাখে। জনগণের আন্দোলনের ফলে স্বৈরশাসকরা কখনও বা গণতন্ত্রের মূলো সামনে ঝুলিয়ে দেখিয়েছে। ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলেও দীর্ঘ স্বৈরশাসনের ধারাই অব্যাহত রয়েছে। সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সংসদীয় পদ্ধতিতে দেশ চলছে না, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেখা যাচ্ছে না, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান। তাঁর তারুণ্যের রাজনৈতিক সচেতনতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর দেশপ্রেম ও সাহস। তাঁর সমসাময়িক নেতা এবং তাঁর ঐ সময়কার বক্তৃতাবিবৃতি এবং করাচির গণপরিষদের ভাষণগুলো পাঠ করলে দেখা যায় বাংলার স্বাধিকার, বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-দারিদ্র্য-দুর্গতি এবং শোষণ-বঞ্চনার কথা বলিষ্ঠভাবে তাঁর মতো আর কেউ উচ্চারণ করত না। আবার দলীয় রাজনৈতিক সাংগঠনিক তৎপরতায় দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যন্ত মাটি ও মানুষের কাছাকাছি পৌছানোর দরদী নেতা একমাত্র তিনিই ছিলেন। পাকিস্তানি স্বৈর-শাসকগোষ্ঠী তো বটেই, যেসব বাঙালি রাজনৈতিক নেতা তাদের তল্পিবাহক ও মদদপুষ্ট ছিলেন, তাদের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আতঙ্ক। এর কারণ হল বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী মানসিকতা ও সাহসিকতা। তাই জেল-জুলুম, বিচার-শাস্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ ইত্যাদি কোনোকিছু দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দমানো যায়নি।

বঙ্গবন্ধুর এই সাহসার্জনের প্রধান শক্তি ছিল বাংলার জনগণ। তাঁর জীবনের শুরুটাই তো ছিল গ্রাম, গ্রামের মানুষ – একজন বিশুদ্ধ বাঙালি হিসেবে তাঁর জীবনাচরণ। আর সেইসঙ্গে দেশ ও সমাজের প্রতি তাঁর যে অঙ্গীকারবদ্ধতা তা তো তিনি নিজের জীবন দিয়েই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

পঞ্চাশের দশকের তাঁর রাজনৈতিক জীবন লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দিকদর্শন গ্রহণে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি যে ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রদান করেন তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার হিসেবেও আখ্যা দেয়া যায়। এই ৬-দফা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিজের জীবনের পানে না তাকিয়ে এই স্বাধীনতা অর্জনও করলেন।

বঙ্গবন্ধু-বিরোধীদের প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এসব বিরোধীদের মধ্যে যারা এই বাংলাদেশে তখনও এবং এখনও স্বাধীন বাংলাদেশে বসেই বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে থাকেন, বঙ্গবন্ধুর ছিদ্রান্বেষণ করে থাকেন, কখনও তারা জনগণের উপর আস্থাশীল নন – আস্থাশীল নন বলেই সবসময় ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে একদিকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট নিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন এবং অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে দেশকে এক অরাজনৈতিক ও অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন।

বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন কোনো সময়ের সীমাবদ্ধতায় নয়। বাঙালির ইতিহাস যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, বাঙালির জাতীয় পরিচয় যতদিন থাকবে এবং মানবজাতির সভ্যতা ও সংগ্রামের ইতিহাস যতদিন পর্যন্ত লিখিত হবে; বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম অবশ্যই সগৌরবে উচ্চারিত হবে। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তিনিই বাস্তবায়িত করে গেছেন। এই মহৎ কীর্তির জন্য শুধুমাত্র ১৩০০ সালের শ্রেষ্ঠ সন্তান তো বটেই, বাঙালির শতাব্দীর-পর-শতাব্দীব্যাপী যে ইতিহাস এগিয়ে যাবে অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রামী আদর্শ অনাগত বাঙালিকে উজ্জীবিত করবে।

সূত্রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার- বেবী মওদুদ, পৃষ্ঠা নং- ৫১-৫৬

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত