বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেমে থাকার নয়

6983

Published on আগস্ট 12, 2018
  • Details Image

সিমিন হোসেন রিমিঃ

কারাগারে বন্দি জীবনের একাকীত্বের মাঝে একের পর এক গণমানুষের মুক্তির চিন্তার ছবি আঁকেন তিনি মনে মনে। তাঁর অন্তরদৃষ্টি ছুটে বেড়ায় বাংলার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে। নিজ মাতৃভূমি এবং একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতিও প্রবলভাবে নাড়া দেয় তাঁর অন্তরকে। পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ভাবেন পরিবেশ পরিস্থিতি এবং এর অনুষঙ্গ নানা ধরনের মানুষকে নিয়ে। স্বপ্নের জাল বোনেন ভবিষ্যতের। মানুষের কষ্ট হাহাকারে কখনো বেদনায় আক্রান্ত হন। কিন্তু না, মুহূর্তেই কষ্টের গভীরতায় মুক্তির পথ খোঁজেন।

নিজেই নিজের মনকে সাহস যোগাতে গভীর বিশ্বাসে উচ্চারণ করেন:‘বিপদে মোরে রক্ষা কর/এ নহে মোর প্রার্থনা।/বিপদে আমি না যেনো করি ভয়।’ তাঁর মন বলে মুক্তি আসবেই। এই প্রত্যয়ী মানুষ, আমাদের প্রাণের মানুষ, এই বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি একই সঙ্গে তার পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সকলকে।

যাঁকে হারানোর বেদনা অমোচনীয় তিনি কালে কালে হয়ে ওঠেন সকল প্রেরণার উত্স। জীবনের পথচলায় বঙ্গবন্ধুকে তিলে তিলে জয় করতে হয়েছিল দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। সহ্য করতে হয়েছিল নিদারুণ নিপীড়ন। তারপরও সবকিছু সহ্য করে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় তিনি খুঁজেছেন মানুষের সার্বিক মুক্তির পথ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য নাম। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

বঙ্গবন্ধুর লেখনী, তাঁর ভাষণ পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায়, তার চিন্তার জগত্ জুড়েই ছিল মানুষের জন্য কল্যাণ ভাবনা। ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনোদিন লিখে রাখেন, ‘তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে মুখে আলাদা না হওয়াই উচিত।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮)। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর তরুণ বয়সের অন্তরের বিশ্বাসকে প্রকাশ করেন অকপটে, ‘যে কোনো মহত্ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত না, তারা জীবনে কোনো ভালো কাজ করতে পারেনি— এ বিশ্বাস আমার ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এ দেশে রাজনীতি করতে হলে ত্যাগের প্রয়োজন আছে এবং আমাদের ত্যাগ করতে হবে পাকিস্তানের জনগণকে সুখী করতে হলে’। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১২৮)।

এ অঞ্চলের মানুষের সবলতা দুর্বলতা তাঁর নখদর্পণে। তাইতো নেতৃত্বের গুণ দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে সুবিধাবাদী মানুষ সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাকে বঙ্গবন্ধু সর্তক দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করেন। কারাগারের নির্জনতায় রোজনামচার অনেকটা অংশ জুড়ে লিখে রাখেন ইতিহাস এবং জীবনঘনিষ্ঠ সে সব কথা। কারাগারের আঙ্গিনায় এক টুকরো প্রকৃতির বর্ণনা ফুটে ওঠে তাঁর রোজনামচায়। বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতে শুরু করেছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভালো লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দুর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলো বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমত্কার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলোকে আমার বড় ভয়, এগুলো না তুললে আসল গাছগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবীদ— যারা সত্যিকার দেশপ্রেমিক তাদের ধ্বংস করে এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে অনেকগুলো তুললাম।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা: ১১৭)।

মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা যেমন ছিল দিগন্ত বিস্তৃত, তেমনি এদেশের মানুষও তাঁকে গভীর ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছিল আস্থায় বিশ্বাসে। দেশ হবে ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম এক সোনার দেশ এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।

স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ চরম দরিদ্র দেশ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের পথে পা বাড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তব রূপায়নকে স্তব্ধ করে দেয়। কিন্তু সত্যের জয়কে প্রলম্বিত করা যায় কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বে দেশ সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে এক বিস্ময়ের নাম। ছোট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে ১৬ কোটি মানুষের বসবাস সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল দেশ। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়, বিদ্যুত্ উত্পাদন বৃদ্ধি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাসকরণ, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেমে থাকার নয়।

লেখক:সংসদ সদস্য, সমাজকর্মী ও প্রাবন্ধিক

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত