বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও যোগাযোগ কৌশল, আসতে পারে নতুন তত্ত্ব

999

Published on মে 13, 2021
  • Details Image

শরীফা উম্মে শিরিনাঃ

২০১৭ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর। কারণটা কী? বলছি...১৭ কে উল্টে দিলেই কিন্তু ৭১ হয়। এই ২০১৭ সাল আমাদের ১৯৭১ এর স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে বারবার। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, সেই উদ্ধত তর্জণী, সেই উত্তাল সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রকাশ্যে স্বাধীনতার রণকৌশল ঘোষণার সেই ঐতিহাসিক দিনটি। এই ভাষণের মাহাত্ম্য অনেক। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ এটি। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে ইউনেস্কোর কর্তৃক ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ কারণেই এই বছরটি আমাদের কাছে আনন্দের ভিন্নমাত্রা যোগ করে।

এর আগ পর্যন্ত ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাঙালি জাতির মুক্তির, গর্বের ও ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ছিল। কিন্তু ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙালি জাতির এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিক চরাচরে পৌঁছে যায় এটি। সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত- নিগৃহীত মানুষের মুক্তির সনদে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধুর এই ট্রেডমার্ক ভাষণটি। এখণ পর্যন্ত বিশ্বের কমপক্ষে ১২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণ।

এখানে স্বল্প পরিসরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের যোগাযোগের ধরণ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এই ভাষণে চারটি মূল নির্দেশনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, সেগুলো হলো- ‘মার্শাল ল’ বা সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনী তথা সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেওয়া, গণহত্যার বিচার করা, এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এছাড়াও এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য জনগণকে চূড়ান্ত রণপ্রস্তুতির নির্দেশনা প্রদান এবং জনগণকে প্রস্তুত রাখা।

‘মিডিয়াম ইজ দ্য ম্যাসেজ’ অর্থাৎ ‘মাধ্যমই বার্তা’ যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি প্রবাদ প্রতীম বাক্য, যার প্রবক্তা কানাডিয়ান যোগাযোগবিদ মার্শাল ম্যাকলুহান। তাকে রহস্য মানব বলা হয়, কারণ তিনি তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেননি। তাহলে ‘মাধ্যমই বার্তা’ বাক্যের দ্বারা আসলে কী বোঝানো হয়? এটি দ্বারা আসলে বোঝানো হয় যে- গণমাধ্যমের আধেয় বা তথ্য গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং মাধ্যমটাই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, দেশের সর্বাধিক বিক্রিত পত্রিকা প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন বা সময় টিভি কী তথ্য দিলো; সেটার চেয়ে এখানে প্রথম আলো-বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা পড়া বা সময় টিভি দেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন ম্যাকলুহান।

কিন্তু, গণমাধ্যম বিষয়ক ম্যাকলুহানের এই তত্ত্ব বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটাই হয়েছে। বরং এক্ষেত্রে বলা যায় ‘ম্যাসেজ ইজ দ্য মিডিয়াম’ অর্থাৎ, ‘মাধ্যম নয়, বার্তাই মুখ্য’।

কারণ সেদিনের ওই ভাষণ কোনে রেডিও বা টেলিভিশনে প্রচার হলো এবং কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হলো- সেটা মুখ্য বিষয় ছিল না; বরং ভাষণ শোনা বা পড়া যাচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি এখনো ৭ মার্চের ভাষণের ক্ষেত্রে মাধ্যমের চেয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তাগুলোই মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে অজ্ঞাতসারেই ‘ম্যাসেজ ইজ দ্য মিডিয়াম’-এই তত্ত্বের ধারণার দাবিদার বঙ্গবন্ধু।

অন্যদিকে, গণমাধ্যমের ‘এজেন্ডা সেটিং’ (আলোচ্যসূচি নির্ধারণ) তত্ত্ব দিয়েছেন দুই যোগাযোগবিদ ম্যাক্সওয়েল ম্যাককম্বস ও ডোনাল্ড শ। এই তত্ত্বের আবির্ভাব ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ‘গণমাধ্যম জনগণের আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে দেয়’- এটি এই তত্ত্বের মূল কথা। অর্থাৎ, জনগণ কী নিয়ে চিন্তা করবে, কী নিয়ে কথা বলবে- সেটা গণমাধ্যম ঠিক করে দেয়। অবশ্য পরবর্তীতে এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বকে মিডিয়া এজেন্ডা (গণমাধ্যমে যেসব বিষয় আলোচিত হয় ও গুরুত্ব পায়); পাবলিক এজেন্ডা (জনগণের মধ্যে যে বিষয়গুলো বহুলভাবে আলোচিত হয় ও যে বিষয়গুলোকে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে) এবং পলিসি এজেন্ডা (রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক বা আইনপ্রণেতারা যে বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে)-এই ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

এই তত্ত্বকেও চ্যালেঞ্জ করে ৭ মার্চের ভাষণ। যদিও মার্কিন নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে, আর জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ দেন ১৯৭১ সালে। তাত্ত্বিকরা মার্কিন নির্বাচনের পরিবর্তে এই ভাষণ নিয়ে কাজ করলে হয়তো আমরা এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের উল্টো চিত্র দেখতে পেতাম। সেক্ষেত্রে ইন্ডিভিজ্যুয়াল এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব পেতাম। অর্থাৎ, গণমাধ্যম নয়, বরং ব্যক্তিই গণমাধ্যমের এজেন্ডা তথা আলোচ্যসূচি নির্ধারণ করে দেয়- এই ধরনের একটি তত্ত্ব আসতে পারত। তবে এখনো এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের মিডিয়া, পাবলিক ও পলিসি এজেন্ডার সাথে ইন্ডিভিজ্যুয়াল এজেন্ডাও আলোচিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছাড়াও বিশ্বের জগৎ বিখ্যাত ভাষণসহ ভবিষ্যৎ ভাষণও এর আলোকে ব্যাখ্যা করা যাবে।

বঙ্গবন্ধু একজন দূরদর্শী যোগাযোগবিদ ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী’র অহিংস এবং নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু’র সহিংস আন্দোলনের দর্শন একত্রিত করতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেছেন এভাবে, ‘...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি স্বাধীনতার কথা আগে বলতে পারতেন কিন্তু বলেননি। কারণ তিনি জানতেন স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার কারণে তিনি মুক্তির কথাই আগে উচ্চারণ করেছেন। তিনি এও জানতেন যে- মুক্তির সংগ্রামের শেষ নেই। স্বাধীনতার পরও মুক্তির সংগ্রাম করতে হবে, আমাদের যার জন্য তিনি মুক্তির সংগ্রামের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। বাস্তবতাই তাই, আমাদেরকে এখনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ক্ষুধা ও দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সার্বিক দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, যোগাযোগের ছাত্র না হয়েও বঙ্গবন্ধু একজন সফল যোগাযোগবিদ ছিলেন।

উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী ও সুবাস চন্দ্র বসুর যোগাযোগ দর্শন (কমিউকেশন ফিলোসফি) নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। তবে কেন বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ দর্শন (কমিউকেশন ফিলোসফি) নিয়ে গবেষণা হবে না?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত