ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবতা

1103

Published on জুলাই 29, 2021
  • Details Image

জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপিঃ

২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় যে ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন এবং সহজেই নাগরিক সেবা প্রাপ্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি, শিল্প-বাণিজ্য ও উৎপাদন, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালনা করার লক্ষ্যেই এই ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। এতে দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে প্রযুক্তি যেমন করে সহজলভ্য হয়েছে, তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছেও প্রযুক্তিনির্ভর সেবা পৌঁছে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এ অগ্রযাত্রায় দেশের আপামর নাগরিকদের ১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন দিন, ৮ দশমিক ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ এবং ১ মিলিয়ন যাতায়াত হ্রাস পেয়েছে। সব নাগরিক সেবা ও জীবনযাপন পদ্ধতিতে প্রযুক্তি হয়ে উঠেছে এক বিশ্বস্ত মাধ্যম। এখন সেলফোন বা অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে দেশের মানুষ।

ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথডের মূল্য হ্রাস, ইন্টারনেট ব্যবহারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অবকাঠামো সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটেছে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগে প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মূল্য ছিল ৭৮ হাজার টাকা; কিন্তু আমরা প্রতি এমবিপিএস ইন্টারনেটের মূল্য ৩০০ টাকার নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। ২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেখানে ১০ লাখ ছিল, সেখানে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির অধিক। আমাদের নিবিড় প্রচেষ্টায় বর্তমানে পুরো দেশ একই নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে। সারা দেশে ফাইবার অপটিক্যাল কেবল সংযোগের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৫০০টি সরকারি অফিসকে একই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সরকারি দপ্তর থেকে প্রদেয় সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানে দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ, অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়সহ ৫১ হাজারেরও বেশি সরকারি দপ্তরের ওয়েবসাইটের একটি সমন্বিত রূপ বা ওয়েবপোর্টাল হচ্ছে জাতীয় তথ্য বাতায়ন। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নে সরকারি দপ্তরের এ পর্যন্ত ৬৫৭ ই-সেবা এবং ৮৬ দশমিক ৪৪ লাখেরও বেশি বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট যুক্ত করা হয়েছে। এ বাতায়নে প্রতিদিন গড়ে এক লাখেরও বেশি জনগণ তথ্য ও সেবা গ্রহণ করছে। এত সহজে সরকারি সেবা সম্পর্কে জানার বিষয়টি ১২ বছর আগে মানুষ চিন্তাও করতে পারেনি।

জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন, যা বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) নামে সুপরিচিত। এ সেন্টার থেকে গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুব সহজেই তাদের বাড়ির কাছে পরিচিত পরিবেশে জীবন ও জীবিকাভিত্তিক তথ্য ও প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছে। প্রথমে কেবল ইউনিয়ন পরিষদকেন্দ্রিক এর কার্যক্রম চালু হলেও বর্তমানে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, গার্মেন্টকর্মী ও প্রবাসী নাগরিকদের জন্য আলাদা ডিজিটাল সেন্টার চালু হয়েছে। এসব ডিজিটাল সেন্টার থেকে ২৭০-এর বেশি ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা জনগণ গ্রহণ করতে পারছে। ডিজিটাল সেন্টার সাধারণ মানুষের জীবনমান সহজ করার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে দিয়েছে। মানুষ এখন বিশ্বাস করে, ঘরের কাছেই সব ধরনের সেবা পাওয়া সম্ভব। মানুষের এই বিশ্বাস অর্জন ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলায় সবচেয়ে বড় পাওয়া। কেবল স্থানীয় সেবাই নয়, প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে দেশে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে ফ্রিল্যান্সিং করেও তরুণরা উপার্জন করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। বর্তমানে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় ১০০ কোটি ডলারের বেশি। এ আয় এ বছর ৫০০ কোটি ডলারে উত্তীর্ণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

১২ বছর ধরে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তির নানা উদ্যোগের ফলে শিক্ষা কার্যক্রম এখন অনেকাংশেই সহজতর হয়েছে। পেয়েছে বৈশ্বিক মান। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন কারিগরি ও অনলাইন প্রযুক্তিগত ডিজিটাল জ্ঞান তৈরি করছে নানা কর্মসংস্থান। ‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার’—এ স্লোগান সামনে রেখে দেশের সব মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু করা হয়েছিল মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমকে আরো সহজ করে তুলতে এটুআইয়ের সহযোগিতায় তৈরি করা হয়েছে ‘কিশোর বাতায়ন’ ও ‘শিক্ষক বাতায়ন’-এর মতো প্লাটফর্ম। এ প্লাটফর্মগুলোর ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বিভিন্ন অনলাইন কনটেন্ট থেকে নিত্যনতুন জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া ‘মুক্তপাঠ’ বাংলা ভাষায় সর্ববৃহৎ ই-লার্নিং প্লাটফর্ম। যেখানে সাধারণ, কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ রয়েছে।

করোনার মতো মহামারীর সময়েও দেশব্যাপী লকডাউনে শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম যেন থেমে না যায়, সেজন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা এবং কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে, যা সংসদ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে দেশব্যাপী সম্প্রচার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত মোট অনলাইন ক্লাস প্রচারিত হয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮টি এবং আপত্কালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রমে ৫ হাজার ৮৬ জনেরও বেশি শিক্ষক যুক্ত রয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নিয়মিত শ্রেণী কার্যক্রম এবং সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ডিজিটাল মাধ্যমে কার্যকরী ও সহজ উপায়ে চলমান রাখতে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ প্লাটফর্ম চালু করা হয়েছে। এ প্লাটফর্মের মাধ্যমে লাইভ ক্লাস বা ট্রেনিং পরিচালনা, এডুকেশনাল কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট, মূল্যায়ন বা অ্যাসেসমেন্ট টুলস, মনিটরিং এবং সমন্বয় করার প্রযুক্তি যুক্ত রয়েছে।

২০০ বছরেরও অধিককাল ধরে বিদ্যমান বিচারিক কার্যক্রমের ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় বাতায়ন, যার মাধ্যমে উচ্চ ও অধস্তন আদালতের বিচার বিভাগের সব কার্যক্রম নথিভুক্ত থাকবে। এছাড়া করোনাকালীন ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম প্লাটফর্মের মাধ্যমে ৮৭টি নিম্ন আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ বিচার বিভাগের জন্য তৈরীকৃত এ প্লাটফর্মে একই সঙ্গে শুনানি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য একটি সুরক্ষিত ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম সংযুক্ত করা হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় এ পর্যন্ত ২৭ হাজারের বেশি জামিন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ হাজারেরও বেশি জামিন শুনানির তারিখ নির্ধারণ এবং ১১ হাজারের বেশি ভার্চুয়াল শুনানি সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রায় নয় হাজার আইনজীবী এ প্লাটফর্মে নিবন্ধিত হয়েছেন।

তথ্যপ্রযুক্তি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফলে দ্রুত দেশের যেকোনো প্রান্তে অর্থনৈতিক লেনদেনের সুবিধা সাধারণ মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে স্বস্তি। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিস্তৃতি ঘটেছে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি সহায়তা প্রদানের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ প্লাটফর্ম। এরই মধ্যে শতাধিক স্টার্টআপকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক এফ-কমার্সেরও বিস্তার ঘটেছে। এমনকি মূলধারার ব্যবসায়ীরাও প্রযুক্তির সহায়তা নিতে এফ-কমার্সমুখী হচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আরেক বড় অগ্রগতি হয়েছে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত করার বিষয়টি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য বলছে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। দেশের ই-কমার্স ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে ‘একশপ’-এর। যেখানে প্রান্তিক অঞ্চলের পণ্য উৎপাদনকারীরা কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা কৃষি বাতায়ন ও কৃষক বন্ধু কলসেন্টার চালু করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কৃষিবিষয়ক সেবার জন্য কলসেন্টার হিসেবে কাজ করছে ‘কৃষক বন্ধু’ (৩৩৩১ কলসেন্টার)। ফলে সহজেই কৃষকরা ঘরে বসে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। ‘কভিড-১৯’-এ যখন সারা বিশ্ব ব্যবস্থা স্থবির। এই মহামারী পরিস্থিতিতে মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছিল, তখনও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল উদ্যোগ মানুষকে দেখিয়েছে নতুন পথ, জুগিয়েছে প্রেরণা। সরকারি অফিসগুলোয় চালুকৃত ই-নথি ব্যবস্থা সেবা কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করেছে। করোনা মহামারীর সময়ে ৩০ লাখের অধিক ই-নথি সম্পন্ন হয়েছে। এতে সরকারি সেবা কার্যক্রম নাগরিকের কাছে আরো সহজে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

করোনা মহামারীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ গ্রহণ করেছে বিজনেস কন্টিনিউটি প্ল্যান। প্রযুক্তির সহায়তায় করোনা সচেতনতা, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ধরনের সেবা দেশের কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা দ্রুত এই করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। জাতীয় হেল্প লাইন ৩৩৩-এর মতো একটি ফোনসেবার মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, নিত্যপণ্য সরবরাহসহ সরকারি তথ্য ও সেবা প্রদান করে আসছে। করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনীয় পরামর্শ, করোনা সম্পর্কিত সব সেবার হালনাগাদ তথ্যের জন্য করোনা পোর্টাল তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে কোটি মানুষকে করোনা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করা হয়েছে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবাকে আরো ত্বরান্বিত করতে চালু করা হয়েছে স্পেশালাইজড টেলিহেলথ সেন্টার। পাশাপাশি গর্ভবতী ও মাতৃদুগ্ধদানকারী মা ও শিশুর নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে মা টেলিহেলথ সেন্টার সার্ভিস তৈরি করা হয়েছে, এর মাধ্যমে লক্ষাধিক মা ও শিশুকে সেবা প্রদান করা হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও প্রবাস বন্ধু কলসেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। প্রযুক্তিনির্ভর বাজার ব্যবস্থায় ফুড ফর নেশনের মতো প্লাটফর্মের মাধ্যমে সারা দেশের উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হয়েছে। করোনা ট্রেসার বিডি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিতকরণের কাজ করছে। এছাড়া গুজব ও অসত্য তথ্য রোধে দেশব্যাপী সত্য-মিথ্যা যাচাই আগে ইন্টারনেটে শেয়ার, পরে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছে।

‘ফোর টায়ার ন্যাশনাল ডাটা সেন্টার’ প্রকল্পের আওতায় দেশে একটি সমন্বিত ও বিশ্বমানের ডাটা সেন্টার গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ই-সেবা সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ই-সেবাগুলোর সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে জনসেবা উন্নত হবে। ইন্টারঅপারেবেলিটি সমস্যা দূরীকরণ ও প্রক্রিয়া সহজসাধ্য করার জন্য বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার (বিএনডিএ) তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের জন্য ‘ই-গভ মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় বাংলাদেশের নয়টি পৌরসভা ও একটি সিটি করপোরেশনে ডিজিটাল মিউনিসিপালিটি সার্ভিস সিস্টেম (ডিএমএসএস) উন্নয়নের মাধ্যমে নাগরিক সেবাগুলো অনলাইন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ডিএমএসএস বাস্তবায়ন করা হবে। উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিশ্ববাজারে প্রবেশ উপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তাদের আরো উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের স্টার্টআপ ফান্ড প্রদান করছে সরকার।

হাই-টেক শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকার ৩৯টি হাই-টেক পার্ক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপন করছে। এগুলো নির্মাণ সম্পন্ন হলে তিন লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হয়েছে। এরই মধ্যে চালুকৃত পাঁচটি পার্কে ১২০টি প্রতিষ্ঠান ৩২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এবং আইটিতে দক্ষ ১৩ হাজারের অধিক কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রতিযোগিতা মোকাবেলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইওটি, রোবোটিকস, সাইবার সিকিউরিটির উচ্চ প্রযুক্তির ৩১টি বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর স্থাপন করা হবে। প্রযুক্তি ও জ্ঞাননির্ভর প্রজন্ম বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্যই ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিতকে আরো শক্তিশালী করা।

করোনাকালীন আইসিটি বিভাগের সহযোগিতায় সারা দেশের ১ লাখ ১০ হাজার গুরুত্বপূর্ণ স্থান গুগল ম্যাপ ও ওপেন স্ট্রিট ম্যাপে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার হাসপাতাল, ১৬ হাজার ফার্মেসি এবং ২০ হাজার মুদি দোকান সন্নিবেশিত করার পাশাপাশি ৮৭০টি রাস্তা ম্যাপে যুক্ত হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মোকাবেলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রাজধানীর আইসিটি টাওয়ারে ই-গভর্নমেন্ট মাস্টার প্ল্যান রিপোর্ট প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ডিজিটাল সেবার বিস্তৃতি ও উন্নতি ঘটিয়ে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকবে।’

এক যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মযজ্ঞ শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন এবং সেবা প্রদানের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর বিস্তৃতি ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া সাউথ-সাউথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সোমালিয়া, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ফিজি, ফিলিপাইনস ও প্যারাগুয়ের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এসডিজি, ওপেন গভর্নমেন্ট ডাটা, চেঞ্জ ল্যাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান এবং সেবা বা সিস্টেম আদান-প্রদান করা হচ্ছে। যেখানে পাঁচটি বেস্ট প্র্যাকটিস চিহ্নিত করা হয়েছে। বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো হচ্ছে ডিজিটাল সেন্টার, সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড, অ্যাম্পেথি ট্রেনিং, টিসিভি ও এসডিজি ট্রেকার। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হওয়া এসব ডিজিটাল কার্যক্রমের মডেল বাস্তবায়িত হচ্ছে বিদেশের মাটিতেও।

বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপ ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্তের ফলে সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গনে স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, গার্টনার, এটিকারনিসহ বেশকিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি এর উদাহরণ। তরুণ প্রজন্ম কেবল চাকরিমুখী না হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় নিজেরাই গড়ে তুলছে ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক সেবাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, তা শুধু স্বপ্ন বা স্লোগানই নয়; বরং তা আজ দৃশ্যমান। যার সুফল ভোগ করছে দেশের প্রতিটি মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যের অন্যতম মাধ্যম তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ। গত ১২ বছরের ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা আমাদের আত্মবিশ্বাসী করেছে। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে। এ দেশের তরুণরা এখন কেবল স্বপ্ন দেখেন না, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে জানেন। এখন গর্ব করেই বলা যায়, বাংলাদেশের এই অদম্য যাত্রায় অচিরেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বনির্ভর ও আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ।

লেখক: প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

সৌজন্যেঃ বণিক বার্তা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত