অন্যরকম করোনা

3119

Published on মার্চ 22, 2020
  • Details Image

অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল):

মেসেঞ্জার আর ফেসবুকের আজকের জমানায় আমার মতো অনেকেরই প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে চমৎকার সব মেসেজে। গান থেকে শুরু করে অমর বাণী, ফুলের ছবি অথবা কার্টুন কি নেই? বাঙালী যে কতটা উদ্ভাবনী শক্তি ধারণ করে, তার নমুনা সাত-সকালে আরও একবার আত্মস্থ করে ধাতস্ত হতে হতে ছুটতে হয় কাজে। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমার মতো এটাই এখন বেশির ভাগ টাচফোন ইউজারের প্রাত্যহিক সিডিউল। এই মেসেজগুলোর অনেকগুলো সমসাময়িক প্রেক্ষিতের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা। এই যে ইদানীং করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত অনেকেই, এর পরিপ্রেক্ষিতে নানা রকম মেসেজ আদান-প্রদান চলছে ভার্চুয়াল জগতে। সেদিন সকালে ওয়াটসএ্যাপে পেলাম এমনি এক মেসেজ। ঘনিষ্ঠ একজন লিখেছেন করোনা নিয়ে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ছোট বেলা থেকেই আমরা ‘করো না-য়’ অভ্যস্ত। ‘এটা করো না, সেটা করো না’- এসব শুনেই কেটেছে আমাদের শৈশব, যৌবন আর এখন মধ্যবয়স। অদ্ভুত রসবোধ! করোনা নিয়ে এমনি রসবোধের পাশাপাশি নানা তথ্য সন্ত্রাসের ছড়াছড়ি এখন সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে। তবে সেসব নিয়ে লেখার আগে গতানুগতিক কিছু বলে নেয়াটা জরুরী।

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। টিস্যু কিংবা রুমালে, আর তার চেয়েও ভাল হয় যদি কাঁধ আর কনুইয়ের মাঝামাঝিটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা হয়। হাত ধুতে হবে বার বার আর তার জন্য সাবানই যথেষ্ট, প্রয়োজন নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজানের। যেখানে-সেখানে থুথু না ফেলা, সর্দি-কাশি, জ্বর-জারি, চোখ চুলকানো কিংবা মাংসে ব্যথা হলে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া আর বিদেশ থেকে ফিরলে দেশে এসে সপ্তাহ দুয়েক নিজ বাসায় স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইনে থাকা এসব নাগরিক দায়িত্ব পালন করাটাও জরুরী। পাশাপাশি এড়িয়ে চলতে হবে জনসমাবেশ।

তবে আগেই যেমনটি লিখেছি, আমার এই লেখাটার উদ্দেশ্য একেবারেই অন্য। করোনা নিয়ে যা করা উচিত না, প্রচার-প্রচারণায় কারও কারও যেন সেটার করার আগ্রহটাই বেশি বেশি। না জেনে-বুঝে মিডিয়ায় হাজির হচ্ছেন অনেকেই, বিজ্ঞ সেজে নেয়ার চেষ্টা করছেন সস্তা কৃতিত্ব, এ ব্যপারটা আমি ভালই বুঝি। কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন মনে হচ্ছে একটা গোষ্ঠী এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে আরও একবার পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে। আমাদের এক সময়কার বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা হর-হামেশাই প্রেসক্লাবে আর টিভি টকশোতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে দায়ী করে চলেছে। এটা অবশ্য তাদের ইদানীংকার রুটিন কাজের অংশ। কোন কিছুতেই সরকারের ভাল কিছু তাদের আর চোখে পড়ে না। বলা হচ্ছেÑ সরকার নাকি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। আমার তো বরং উল্টোটা মনে হয়। বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর ১০৪তম রাষ্ট্র যেখানে করোনার রোগী শনাক্ত হয়েছে। মানব জাতির লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এই ব্যপ্তির মহামারী নিদর্শন নেই। আমরা স্পেনিশ ফ্লু, হংকং ফ্লু, সার্স, মার্স কিংবা তারও আগে ইউরোপের প্লেগ মহামারীর কথা বলতে পারি। কিন্তু এসব কোন ক্ষেত্রেই এতবেশি সংখ্যক দেশে একটি রোগ ছড়ায়নি। অতএব কোভিড-১৯ যে বাংলাদেশে আসবে সেটা তো অবধারিতই ছিল। বরং আমরা যে চতুর্থ না হয়ে ১০৪-এ আক্রান্ত হয়েছি, এজন্য আমি আমার সরকারকে সাধুবাদ জানাতে চাই। গত কয়েকদিন ধরে এসব নেতার মুখে অনেক কথাই শুনেছি। বলা হয়েছিল মুজিববর্ষের কারণে নাকি করোনা আক্রান্তের ঘোষণা দেয়া হবে না। রোগী ধরা পড়ার পরপরই ত্বরিত ঘোষণা দিয়ে যখন মুজিববর্ষ উদযাপনের পরিসর কমিয়ে আনা হলো, তখন নতুন করে বলা শুরু হলো মানুষ মরছে ঠিকই, তবে ঘোষণাটা আসবে ১৭ মার্চের পর। হাস্যকর যত যুক্তি! আজকের এই ফেসবুকের জমানায় তিলকে যখন তাল করা হয়, ঘটানো হয় ‘বোরহানউদ্দিন কা-’ কিংবা চাঁদে দেখানো হয় সাঈদীর ছবি, তখন এদেশে করোনাভাইরাসে ভুগে মানুষ মারা যাবে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাল হবে না, এমন যুক্তি বোধকরি শিশুর কাছেও শিশুতোষ বলে মনে হবে।

আমার কাছে বরং মনে হয় সরকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রোএকটিভ ভূমিকা নিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের দেশগুলো যখন একাধিক মৃত্যুর পর বিমান চলাচল সীমিত করেছে কিংবা বন্ধ করেছে স্কুল-কলেজ, তখন আমরা তা করেছি একদম শুরুতেই, যখন আমাদের করোনা রোগীরা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরছেন। হোম কোয়ারেন্টাইন এ ধরনের প্যান্ডেমিক মোকাবেলায় স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের তা থোরাই কেয়ার! আমরা হোম কোয়ারেন্টাইন না মেনে ঘুরে বেড়াব বাজারে-দোকানে অথচ কোয়ারেন্টাইনের বিরুদ্ধে এমন হল্লা বাধাব যে নামাতে হবে সেনাবাহিনী পর্যন্ত। আবার এই আমরাই আবার দেশকে গালি দিব ‘ব্লাডি কান্ট্রি’ বলে আর সব দোষ চাপাতে চাইব সরকারের ঘাড়ে। আসলে আমার কেন যেন মনে হয়, আল্লাহ না করুক এদেশে যদি করোনা পরিস্থিতি কখনও ভয়াবহ রূপ নেয়, তবে তার জন্য আমাদের অন্য কোথাও কারণ না খুঁজে খুঁজতে হবে আমাদের বিবেকের দুয়ারে!

করোনায় ধুয়া তুলে পচা রাজনীতির চেষ্টা শুধু দেশে না, হচ্ছে দেশের বাইরেও। মাত্র কয়েকদিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা সংযুক্ত হয়েছিলেন একটি লাইভ ভিডিও কনফারেন্সে। ভালই এগুচ্ছিল কনফারেন্সটির। হঠাৎ করে সার্ককেন্দ্রিক এই উদ্যোগে একটু অবাকই হয়েছিলাম বৈকি। মন দিয়ে তাই দেখছিলাম বিটিভির লাইভ সম্প্রচার। মুগ্ধ হচ্ছিলাম দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃত্বের উদ্যোগ আর আন্তরিকতায়। সত্যিই মনে হচ্ছিল নজির গড়তে যাচ্ছেন তারা বিশ্বের সামনে। টিভির পর্দায় ইমরান খানের অনুপস্থিতি পুরো আয়োজনের গুরুত্বটা একটু কমিয়ে দিলেও, আমার বরং ভালই লাগছিল। মনে হচ্ছিল ‘একাত্তরের কসাই’ জেনারেল নিয়াজীর ভাতিজা পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিয়াজীর অনুপস্থিতি বরং এই সৎ উদ্যোগটাকে শুদ্ধতর করেছে। কিন্তু ওই যে ‘এক বালতি দুধে এক ফোটা মূত্র যেমন’, পুরা উদ্যোগটিতেই পানি ঢেলে দিল এই ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেয়া প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টার শেষের মন্তব্য। আলোচনাটা যখন একটা সুন্দর সমাপ্তির দিকে এগুচ্ছে তখনই ‘কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি’ স্টাইলে হঠাৎই হাওয়া থেকে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যু টেনে এনে পুরো জিনিসটাই কেমন যেন নষ্ট করে দিল এই পাক কর্মকর্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই ব্যক্তির কিছু কিছু আমলনামা এখন আমাদের সামনে। নিজ দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে অবৈধভাবে বিশ মিলিয়ন মাস্ক বিদেশে পাচারের অভিযোগ এখন এই জাফর মির্জার বিরুদ্ধে তদন্তাধীন। অতএব পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার আঙ্গুল নাচানোয় এই ভদ্রলোক যে নাচতে বাধ্য তাতে আর অবাকের কি?

যদি খেয়াল করে থাকেন দেখবেন এই বক্তব্যটি দেয়ার ঠিক আগে তার টেবিল থেকে একটি কাগজ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক ব্যক্তি আর তারপর টেবিলের বাম কোনা থেকে তাকে আরেকটি কাগজ এগিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় এই কাগজটিতেই সম্ভবত জম্মু-কাশ্মীরের বিষয়টি লেখা ছিল। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পজিটিভ ভূমিকায় এই ভিডিও কনফারেন্সটি যে বিশ্ব মিডিয়ায় ঝড় তুলতে যাচ্ছে তা টের পেয়েই যে এই ‘পাকিস্তানী নষ্টামি’ তা আমার কথা বিশ্বাস না হলে, ইউটিউবে সেদিনের ভিডিও কনফারেন্সটি আরেকবার মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলেই বুঝতে পারবেন। এই করোনা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানী মেশিনারি আর তাদের এদেশীয় দোসরদের এই যে দেশে-বিদেশে ‘সব শেয়ালের এক রা’-টাইপ অবস্থান, এটি কিন্তু বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

করোনা নিয়ে স্রোতের বিপরীতে এই লেখার উদ্দেশ্য আমার একটাই। করোনা নিয়ে আমাদের খালি ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আর অর্থনৈতিক ফ্রন্টে’ প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, এ প্রস্তুতি হতে হবে বহুমাত্রিক। না হলে কে যে কোন দিকে ফাউল করে দেবে, পরে তার ধাক্কা সামলানো কঠিন হতে পারে। চীনে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় যে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, তাতে একজন করে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিশারদ অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ওই কমিটিতে মিডিয়াএক্সপার্ট স্থান পেয়েছেন দুজন। আর চীনা কূটনীতিকরা গত দুটি মাসে সারা পৃথিবীতে চারশ’র বেশি সাক্ষাতকার দিয়েছেন আর পত্র-পত্রিকায় আর্টিক্যাল লিখেছেন তিনশ’রও বেশি শুধু চীনের এই ইমেজ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য। করোনার মিডিয়া পার্সপেক্টিভ ও তার ইমপ্লিকেশন তো এ থেকেই স্পষ্ট। করোনায় স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ইমপ্যাক্ট সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যথেষ্ট আর প্রস্তুতিও আশা করি কমবেশি মন্দ নয়। কিন্তু করোনার এই অন্য সেক্টরটির দিকেও মনোযোগ দেয়ার সময়ও বোধ করি এখনই।

লেখক : অধ্যাপক, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ (২১ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত