ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

4250

Published on মার্চ 4, 2020
  • Details Image

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘৮ম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০২০’ উদ্বোধনকালে দেশের সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি এই শিল্প খাতকে (এসএমই) এগিয়ে নিতে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এসএমই খাতে উৎপাদিত অনেক পণ্য বিশ্বমানের। এগুলোর সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জড়িত। কাজেই এই এসএমই খাত উন্নয়নে আমাদের বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বুধবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেটস্থ বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে (কেআইবি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৯দিন ব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করেন।

এসএমই পণ্যের (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) প্রচার এবং স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বছর ৮ম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এসএমই খাতের উন্নয়নে করণীয় হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ৫ দফা নির্দেশনার উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বে ভোক্তাদের চাহিদা-নির্ভর শতভাগ রপ্তানীমুখী পণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হবে।’ দ্বিতীয়ত, ‘দেশজ কাঁচামাল ব্যবহার করে ভারী শিল্পের পরিপূরক পণ্য এসএমই শিল্পের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হবে।’ তৃতীয়ত,‘ এসএমই শিল্পের মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে হবে।’ চতুর্থত, ‘কেউ যাতে আমাদের আর সস্তা শ্রমের দেশ মনে না করে। সেজন্য আমাদের দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে হবে এবং পঞ্চমত, উচ্চতর মূল্য সংযোজনের লক্ষ্য নিয়ে স্বল্প উৎপাদন খরচের সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সংযোগ ঘটিয়ে গ্লোবাল ভ্যালু চেইন’র অংশীদার হতে হবে।

প্রযুক্তি নির্ভর এসএমই খাত গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্দেশনায় বলেন, ‘আমাদের দেশীয় বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ ডিজিটাল, বায়োলজিক্যাল ও ফিজিক্যাল উদ্ভাবনে এগিয়ে রয়েছেন। ভবিষ্যতে উদ্ভাবনী এই তিন ধারার সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। দেশের মাটিতে তা করতে পারলেই আমরা আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারব।’

শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।

শিল্প সচিব মো.আব্দুল হালিম এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো.শফিকুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ,প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ,সংসদ সদস্যবৃন্দ, উচ্চ পদস্থ বেসামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনিতিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকতাবৃন্দ, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ,উদ্যোক্তাসহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৫ জন শিল্প উদ্যোক্তার মাঝে ‘এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার-২০২০’ প্রদান করেন।

পুরস্কার বিজয়ীরা প্রত্যেকে এক লাখ টাকা পুরস্কারের অর্থের চেক, ট্রফি এবং সনদপত্র লাভ করেন।

এবারের শিল্প মেলায় ১৯৫ নারী উদ্যোক্তাসহ মোট ২৯৬ জন এসএমই উদ্যোক্তা তাদের পণ্য প্রদর্শন করবেন। এরমধ্যে রয়েছে- পাটজাত পণ্য, কৃষি ও চামড়াজাত পণ্য, ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রি, হাল্কা প্রকৌশল শিল্প পণ্য, হস্ত ও কুটির শিল্প, প্লাষ্টিক এবং সিনথেটিকজাত পণ্য।

মেলা উপলক্ষে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন, ‘এবারের মেলায় কোন বিদেশি পণ্য থাকবে না।’

মেলায় ৫টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং কোন প্রবেশমূল্য লাগবে না ।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন,‘সরকার সারাদেশে একশ’ বিশেষ শিল্পাঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তুলছে। এই বিশেষ শিল্পাঞ্চলে আমার নির্দেশ রয়েছে আমাদের নারী উদ্যেক্তারা যেন বিশেষ সুবিধা পান।’
‘কারণ আমি মনে করি নারী-পুরুষ যেন সমানভাবে এগিয়ে আসে এবং আরো বেশি করে যেন নারী উদ্যেক্তা সৃষ্টি হতে পারে। সেদিকেই আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে চাই’,যোগ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করবো আমাদের বোনেরা আরেকটু আগ্রহী হবেন।’

স্ত্রীর নামে ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে তুললে স্বামীরা বিশেষ সুবিধা পাবেন উল্লেখ করে সেই সুযোগ গ্রহণে ব্যবসায়ী মহলের প্রতি আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ফসলী জমি রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত, নতুন বাজার সৃষ্টিসহ এসএমই সংশ্লিষ্ট শিল্পের সকল ক্ষেত্রে গবেষণার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে গবেষণাটা একান্তভাবে প্রয়োজন। গবেষণার মধ্যদিয়ে আমরা যেন পণ্য চাহিদা, পণ্য উৎপাদন এবং পণ্য বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে পারি, সেটা আমরা করবো।’

তিনি এসময় এসএমই ফাউন্ডেশনকে গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়ারও নির্দেশ প্রদান করেন।

তাঁর সরকার সবসময় এসএমই ফাউন্ডেশনকে গুরুত্ব দিলেও ‘এখানে উদ্যোক্তার সংখ্যা আশানুরূপ নয়,’ উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, তাঁর আজকের অনুষ্ঠানে আসার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে এসএমই’তে যারা কাজ করবেন এবং ঋণ নেবেন তাঁদের উৎসাহিত করা। কারণ, এর মাধ্যমেই দেশকে বিরাটভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসএমই ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যে সারাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ১৭৭টি ক্লাস্টার চিহ্নিত করেছে এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, স্বল্পসুদে অর্থায়ন, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।’

এসব ক্লাস্টারের উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত সুবিধাদি বৃদ্ধির জন্য যা যা প্রয়োজন সেসব ধরনের সহায়তাও তাঁর সরকার প্রদান করবে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

ব্যাংক ঋণে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনাকেও গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে বিষয়টির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর ফলে আগামীতে নারী উদ্যোক্তাসহ এসএমইখাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তিতে সুবিধা হবে।’

উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকারের বিনাজামানতে ব্যাংক ঋণ কর্মসূচির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে বিনাজামানতে সরকার নবীন উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা প্রদান করছে। এসএমই ফাউন্ডেশন থেকেও ঋণ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজস্ব বাজার সৃষ্টি করতে হবে। সেই সাথে সাথে নতুন নতুন বাজার অন্বেষণ করতে হবে। কোথায় আমরা নতুন বাজার পেতে পারি, কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা বেশি সেটা খুঁজে বের করা এবং সেই ধরনের পণ্য উৎপাদন করা। সেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

পণ্য বাজারজাতকরণে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারজাত করা একটা সমস্যা। সে জন্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।’

একইসঙ্গে কাঁচামাল প্রাপ্তি নিশ্চিত করার কথাও বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমরা যে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলবো তার যে কাঁচামাল তার চাহিদা কিভাবে পূরণ হবে সেটা আমাদের দেখতে হবে, এই কাঁচামাল প্রাপ্তি ও নিশ্চিত করতে হবে।’

ফ্যাশন ডিজাইন এবং পণ্য উৎপাদনে ঋতু বৈচিত্রের বিষয়টি মাথায় রাখার ওপর ও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশ-বিদেশে সবখানেই সবাই দক্ষ জনশক্তি চায়। সেই দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা ১৯৫৬ সালে বাণিজ্য, শিল্প, শ্রম ও ভিলেজ এইড মন্ত্রী ছিলেন। তিনি মাত্র আট মাস এ দায়িত্ব পালন করেন। তারপর মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলকে শক্তিশালী করার কাজে মনোনিবেশ করেন।

তিনি বলেন, জাতির পিতা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প আইন (১৯৫৭) প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বেই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ সরকার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে এসএমই শিল্প বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র আইন (২০১৯), শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ আইন (২০১৮), স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন আইন (২০১৮), ট্রেডমার্ক (সংশোধনী) আইন (২০১৫), ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য আইন (২০১৩)-সহ নানাবিধ আইন প্রণয়ন করেছে।

একইসঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে শহরের সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিতে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।

প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরো বলেন,‘আমাদের সরকার গৃহীত এসএমই নীতি (২০১৯), জাতীয় শিল্পনীতি (২০১৬), বিভিন্ন পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প পুরস্কার নীতিমালা (২০১৯), জাতীয় উদ্ভাবন ও মেধাসম্পদ নীতিমালা (২০১৮) সহ অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণের ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পখাতের অবদান ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।’

বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনকে কেন্দ্র করে তাঁর সরকারের ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে নানা আয়োজনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন ও আত্মত্যাগের ইতিহাস স্মরণ করা হবে।’

২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেশ গড়ে তুলতে এ সময় তিনি সকলের সহযোগিতারও কামনা করেন।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত