ইতিহাসের পাতায় জাতীয় চার নেতা

4828

Published on নভেম্বর 3, 2019
  • Details Image

ড. মো. হাসিবুল আলম প্রধান

শোকাবহ ১৫ আগস্টের পর ৩ নবেম্বর বাঙালী জাতির জন্য একটি শোকের দিন, বেদনার দিন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছাসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্য ও অনেক নিকটাত্মীয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে। মীরজাফর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনীর কতিপয় স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী ক্ষমতালোভী অফিসার খুনী লে. কর্নেল ফারুক, লে. কর্নেল রশিদ, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন নূর প্রমুখ যে নজিরবিহীন বর্বরোচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল তা বাঙালী জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে করেছিল কলঙ্কিত।

ঘাতকরা এতটাই পাষাণ ছিল যে, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু কেউ রক্ষা পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। খুনী চক্র চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বংশের নাম নিশানা চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশরত্ন নেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন দেশের বাইরে অবস্থান না করলে তাদের জীবনেও নেমে আসত একই নির্মম পরিণতি। আর ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নেতৃত্বে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বাঙালীর দুঃসময়ের কান্ডারী জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে। যে কারাগারকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশ্বের সকল রীতি-নীতি ভঙ্গ করে সেই কারাগারেই রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গর্জে ওঠে ঘাতকের রাইফেল আর নিমিষেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আমাদের মহান জাতীয় চার নেতা। এই চার নেতা আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও আদর্শের প্রতি অবিচল ছিলেন, ভালবেসেছেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আপোস নয়, সমঝোতা নয়, কাপুরুষতা নয়, হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার নজিরবিহীন ইতিহাস তারা বিনির্মাণ করে আদর্শের রাজনীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন বিশ্ব রাজনীতির দরবারে। ক্ষমতার লোভকে দু’হাতে সরিয়ে এবং খুনীদের তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে মরণের এই নিশ্চিত আহ্বান ক’জন জানাতে পারেন? বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর অনেক আওয়ামী লীগ নেতার নীরবতা ও আত্মসমর্পণের ঘটনায় যখন সমগ্র জাতি শোকে ও যন্ত্রণায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল, তখন ক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করে এই জাতীয় চার নেতা ৩ নবেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করেছেন কাপুরুষের মতো বাঁচার চেয়ে মৃত্যতেও গৌরব। এ জন্যই তো রাজনীতির কবি শেখ মুজিবের সঙ্গে সঙ্গে এই জাতীয় চার নেতা বাঙালী জাতির ইতিহাসে এবং বাঙালীর অন্তরের অন্তঃস্থলে চির জাগ্রত, চির অম্লান, চির ভাস্বর। বাঙালী যখন অন্তরের চোখ দিয়ে শেখ মুজিবকে দেখে, তখন শেখ মুজিবের পাশাপাশি আরও চারটি মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই মুখগুলো হলো আমাদের অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় জাতীয় চার নেতার মুখ।

তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী- এই চারটি নাম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ চারজনকে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিটি আন্দোলনে, গণআন্দোলনে ও সংগ্রামে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছিলেন। এই চার নেতাকে বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন এবং সেইভাবে তিনি তাদের তৈরি করেছিলেন, যেন তাঁর অনুপস্থিতিতে তারা আন্দোলন সংগ্রাম এবং সর্বোপরি মুক্তি সংগ্রামকে সফলভাবে পরিচালিত করতে পারেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার পর পাকিস্তানী সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের বিষয়টি মূলত আমাদের জাতীয় চার নেতার ওপর বর্তায়। তবে প্রখর নেতৃত্বের অধিকারী ও মেধাবী হওয়ায় এবং কৌশল নির্ধারণে পরিপক্বতার কারণে বিশেষ করে তাজউদ্দীনের ওপর মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাসহ সরকার গঠনের মতো গুরুদায়িত্বটি চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের গভীর সম্পর্কের কারণে সরকার গঠনের কথা ভাবার নির্দেশনা এবং ইঙ্গিত তিনি পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত বর্বরোচিত গণহত্যা বিশ্ববাসীকে জানাতে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার গঠনের কথা মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করে সীমান্তের দিকে পাড়ি জমান, উদ্দেশ্য ভারত গমন। ৩০ মার্চ রাতেই তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম প্রথমে কৃষ্ণনগরে পৌঁছান এবং সেখান থেকে কলকাতা যান। গোলক মজুমদার ও রুস্তমজীর প্রচেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৪ এপ্রিল সন্ধ্যারাতে। এ সাক্ষাৎকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট তাজউদ্দীন আহমদ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। দ্বিতীয় দিন ৫ এপ্রিল আবারও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীনের আলোচনা হয়। এসব আলাচনায় তাজউদ্দীনের প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক আচরণ এবং দূরদর্শিতা ইন্দিরা গান্ধীর মনোযোগ আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় প্রার্থিত বিষয়ে ভারত সরকারের সাহানুভূতি সঞ্চারিত হয় এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া যায। তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লীতে গিয়ে কেবল মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি, তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে একটি সরকার গঠনের প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করা হয় এবং যার ওপর ভিত্তি করে ঐদিনই মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এক বেতার ভাষণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাংলাদশ রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ঐদিন রাত সাড়ে ৯টায় তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে বাংলাদেশ সরকার গঠন সংক্রান্ত ভাষণটি আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ (১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করার মাধ্যমে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণাপূর্বক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে একটি বৈধ সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সকাল এগারোটায় পূর্বনির্ধারিত স্থান মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক বৃক্ষরাজি শোভিত ছায়াসুনিবিড় একটি গ্রামে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভার শপথ পাঠ করানোর পর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন এম. মনসুর আলী (অর্র্থমন্ত্রী), এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী) এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী)। এ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে শোনান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুক্তিযুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে শপথগ্রহণ শেষে তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। এই মুজিবনগর সরকারই অক্লান্ত পরিশ্রম করে মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনে।

জাতীয় চার নেতা ছিলেন যেমন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত, তেমনি ছিলেন প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অধিকারী। বিশেষ করে তাজউদ্দীন ছিলেন অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী। যে কারণে ভুট্টো তাকে চিনতে ভুল করেননি। ভুট্টোর নাকি তাকে নিয়ে আপত্তি ছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে দেখলে নাকি তার চোয়াল শক্ত হয়ে যেত। বলতেন সাদা শার্ট পরা ছোট খাটো লোকটিকে না আনলেই কি নয়? কারণ তাজউদ্দীনকে ভাবাবেগ বা সস্তা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশ করা যেত না। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তারা যে মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ছিল অভূতপূর্ব। বিশেষ করে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নানা উপ-দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংকে ম্যানেজ করে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা যেমন বাঙালী জাতিকে তার প্রতি আস্থাশীল করেছিল, তেমনি তিনি বিশ্ববাসীরও নজর কেড়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী তো নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি তাজউদ্দীন ছাড়া কারও কাছে গোপন কিছু শেয়ার করবেন না। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনেই জাতীয় চার নেতার অন্যতম তাজউদ্দীনকে কিছু মেধাহীন আওয়ামী লীগার তাকে শত্রু ভাবতে শুরু করেন। এমন কি খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তার কিছু অনুসারী মুক্তিযুদ্ধে ফাটল ধরানোরও ষড়যন্ত্র করেন। অবশ্য মোশতাকের এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ১৯৭১-এর অক্টোবরের মধ্যেই ফাঁস হয়ে যায় এবং তাকে কলকাতায় কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

স্বাধীনতার পরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে গড়ে তোলবার দৃঢ় প্রত্যয়ে যখন বঙ্গবন্ধু নিরলসভাবে কাজ করছিলেন, তখন জাতীয় চার নেতা ছায়ার মতো অনুসারী হয়ে দেশগড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চারনেতা বিশেষ করে তাজউদ্দীনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব তৈরি করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ষড়যন্ত্রকারীরা সফলও হয়, যে কারণে ৭৪ এর ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরও তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার জায়গায় ছিলেন অবিচল। এ প্রসঙ্গে ২০১২ সালের ৩ নবেম্বর প্রকাশিত ’জাতীয় চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক তোফায়েল আহমেদের একটি লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীন ভাইকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিদিন তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায় যেতাম। তাজউদ্দীন ভাই বলতেন, দেখো তোফায়েল সারা জীবন যা কিছু করেছি, তার সবই মুজিব ভাইয়ের খাতায় জমা রেখেছি। আমার নিজের খাতায় কিছুই রাখিনি। যে কোন মূল্যে মুজিব ভাইকে বাঁচাতে হবে। মুজিব ভাইকে বাঁচাতে না পারলে আমরা কেউ-ই বাঁচতে পারব না। স্বাধীনতাসহ সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। ভাবতেও অবাক লাগে তাজউদ্দীন ভাই মন্ত্রিসভায় ছিলেন না, সরকারও ছিলেন না অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসার ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।’

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে এমনটি ভাববার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডটি ছিল ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ, বাংলাদশের মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে বিলীন করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে পরিণত করা। হত্যাকারীদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত সূদূরপ্রসারী ও পরিকল্পিত। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে খুনীরা নিশ্চিত হতে পারেনি। তাদের ভয় ছিল জাতীয় চার নেতাসহ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনেক অনুসারীকে, যারা খুনীদের ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাজউদ্দীনকে খুনী চক্রের পক্ষ থেকে সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’ আগস্টের ২২ তারিখে জাতীয় ৪ নেতাসহ আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশে তাঁর যোগ্য রাজনৈতিক উত্তরসূরিরা যেন জনগণকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ গড়তে না পারে, এজন্য খুনীরা অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি থাকা অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করে। কারাগারের অভ্যন্তরে ঘাতকেরা রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে প্রবেশ করে ব্রাশফায়ারে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নির্মমভাবে নিহত হলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষা করার জন্য জঘন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারিকৃত সকল অধ্যাদেশ ও ঘোষণাকে বৈধ হিসেবে অনুমোদন ও সমর্থন দেয়ায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংবিধানের অংশে পরিণত হয়। পৃথিবীর কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে আইন করে খুনীদের রক্ষা করার এরকম দ্বিতীয় কোন নজির নেই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডের বিচার যেমন আইন করে রুদ্ধ করা হয়, তেমনি রুদ্ধ করা হয় ৩ নবেম্বর সংঘটিত জাতীয় চার নেতার নৃশংস হত্যাকান্ডেরও বিচার। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিদেশে পাঠিয়ে ও রাষ্ট্রদূত বানিয়ে নানাভাবে পুরস্কৃতও করেছিল। জেল হত্যার পরদিন ডিআইজি প্রিজন কাজী আব্দুল আওয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। কিন্তুু দীর্ঘদিন বিচার হয়নি। পরবর্তীতে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার শুরু হবার পর বিচার শুরু হয় জেল হত্যার। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মতিউর রহমান এ মামলায় রায় দেন। এ রায়ে পলাতক তিন আসামি ঘাতক রিসালদার মোসলেহ উদ্দন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মোঃ আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদন্ড ও ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ফারুক-রশিদসহ সকলেই অব্যাহতিপ্রাপ্ত, বরখাস্তকৃত এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্য। ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত মেজর খায়রুজ্জামানসহ চার রাজনীতিক-তাহের উদ্দীন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জম হোসেন, কে এম. ওবাদুদ রহমান ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের বেকসুর খালাস দেয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হলে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রায় দেয়। রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি মারফত আলী শাহ ও আবুল হাশেম মৃধাকে বেকসুর খালাস এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (বরখাস্তকৃত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দীন আহমেদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। হাইকোর্টের এই রায় শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও বাংলার মানুষ প্রত্যাখ্যান করে এবং এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় । ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এক অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় এলে এবং জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২য় বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল আবেদন (লিভ টু আপীল) করা হয়। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল আবেদন মঞ্জুর করে এবং যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত চার জনের বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে করা আপীল আবেদন অকার্যকর উল্লেখ করে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি বেঞ্চ এই ঐতিহাসিক মামলায় রায় প্রদান করেন। রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের দায়ের করা আপীল আবেদন মঞ্জুর করে হাইকোর্ট থেকে খালাস পাওয়া পলাতক দুই আসামি আবুল হাসেম মৃধা ও দফাদার মারফত আলী শাহকে নিম্ন আদালতের দেয়া মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে কোন আপীল না করায় এ বিষয়ে আদেশ দেয়া হয়নি। তবে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট আনিসুল হক কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিষয়ে ষড়যন্ত্র হয়েছে উল্লেখ করে আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন। এরই মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৩৮ বছর পর জাতি পায় জেলহত্যার রায় ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির পর বেদনাবিধুর দিনটি হলো ৩ নবেম্বর। ঐদিন জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলেও তাঁদের আদর্শকে হত্যা করা যায় নি। চার নেতা ছিলেন আদর্শবাদী দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি দৃঢ় আস্থা ছিল তাঁদের আমৃত্যু। বাঙালী জাতির আদর্শের বাতিঘর এই চার নেতাকে হত্যা করে ১৫ আগস্টের পর আবারও বাঙালী জাতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞের দন্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন খুনীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় কিছুটা হলেও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। ৩ নবেম্বর হত্যাকান্ডের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ অধিকাংশ দন্ডপ্রাপ্ত আসামি এখনও পলাতক, সুপ্রীমকোর্টের রায় এখনও কার্যকর হয়নি। বাঙালী জাতির ইতিহাসকে পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত করতে হলে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসমিসহ ৩ নবেম্বরের হত্যাকান্ডের দন্ডপ্রাপ্ত সকল পলাতক আসামিকে গ্রেফতার করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করতে হবে। এবারের জেলহত্যা দিবসে এটাই জাতির প্রত্যাশা।

লেখক : প্রফেসর, আইন বিভাগ ও পরিচালক, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত