যোগ্য নেতৃত্বের কারণে বদলে যাওয়া অন্য এক বাংলাদেশ

5698

Published on এপ্রিল 28, 2019
  • Details Image

আবদুল মান্নানঃ

বাংলাদেশের পাঠকদের কেউ কেউ পারভেজ হুদাবয়ের নাম শুনে থাকতে পারেন। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বনামখ্যাত পাকিস্তানের একজন পরমাণুবিজ্ঞানী, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। চিন্তাধারায় প্রগতিশীল এবং পাকিস্তানের যেসব সুধীজন নির্মোহভাবে পরিস্থিতি ও ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক কলাম তাঁর নিজ দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। পারভেজ হুদাবয় পাকিস্তানের ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের কাছে একজন মুরতাদ ও ইসলামের শত্রু। শিক্ষকতা ও গবেষণা করে তাঁর নিজ দেশে ও বিশ্বের একাধিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি ডন পত্রিকায় ‘Why Bangladesh overtook Pakistan’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পারভেজ হুদাবয় লিখেছেন, বাংলাদেশ স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো কোনো স্বর্গরাষ্ট্র নয়। এখানে দারিদ্র্য আছে। দেশটি জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ। আছে দুর্নীতি। নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। মাঝেমধ্যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গণতন্ত্রের চর্চাও প্রত্যাশিত পর্যায়ের না। কিন্তু আগে যে দেশটি সম্পর্কে বলা হতো—এটি সব সময় লাইফ সাপোর্টে আছে, তা অনেক আগেই দূর হয়েছে। তিনি বলেছেন, অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, বাংলাদেশ এশিয়ার আগামী দিনের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি (Next Asian Tiger)। গত বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৯ শতাংশ, যা ভারতের সমান। এই সংখ্যা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ৫.৮ শতাংশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু দেনা ৪৩৪ মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের ৯৮৪ মার্কিন ডলার। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা পাকিস্তানের সরাসরি চার গুণ। বলা বাহুল্য, লেখক যে সময়কার পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছেন, তার চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা বর্তমানে আরো ভালো, যা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন।

হুদাবয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রশ্ন করেছেন, ‘যে বাঙালিদের পাকিস্তানিরা সব সময় অবজ্ঞার চোখে দেখত, যারা একসময় পাকিস্তানিদের হাতে একধরনের বর্ণবাদের শিকার হয়েছে, তারা এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাকিস্তানিরা বলত, বাঙালিরা শুধু ভাত আর মাছ খেতে জানে, তাদের একমাত্র পেশা কৃষিকাজ। যদিও তারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে; কিন্তু কথা বলে মেয়েলি ভাষা বাংলায়, মুসলমানদের ভাষা উর্দুতে নয়। তারা আকারে খাটো, গায়ের রং কালো, মুসলমানদের মতো দীর্ঘাকৃতির ফর্সা নয়। গরিব বাঙাল আমাদের থেকে ১৯৭১-এ পৃথক হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। আবার অনেকে মনে করেছিলেন, একদিন তারা বাপ বাপ করে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে এক হতে কান্নাকাটি করবে, তারা কিভাবে সব কিছুতে টপকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে অনেক দূর চলে গেল?’ তিনি আরো লিখেছেন, “পাকিস্তানিরা ছাদে দাঁড়িয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে পছন্দ করে, মনে করে আণবিক বোমা বানাতে পারলে একটা বিরাট বাহাদুরি; কিন্তু মানবসম্পদ উন্নতিতে অর্থ ব্যয় করাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং ভ্রান্তভাবে ধারণা করে, সেনাবাহিনীই সব সমস্যা দূর করতে পারে আর সেই দেশভাগের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করতে করতেই মূল্যবান সব সময় ও সম্পদ শেষ করে ফেলেছে। তাদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তা-ই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ জানে, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত করতে হলে কোন কোন সূচকের ওপর জোর দিতে হবে।” তিনি আরো লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর সৌদি আরবের পরামর্শে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা বাংলাদেশ বুঝেছে। ভারতের সঙ্গে সামরিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করার মধ্যে পাকিস্তানের উন্নয়ন নিহিত নয়—এটি পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে না। জনগণের উন্নয়ন কিভাবে করতে হয়, তা বাংলাদেশের দিকে তাকালে কিছুটা শেখা যাবে।’

গত ১১ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির একটি। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে তার অবস্থান দ্বিতীয়, আফ্রিকার রুয়ান্ডার পর। রুয়ান্ডা একটি গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তাকে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হয়ে আসতে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো উদার সাহায্যের ব্যবস্থা করছে, যা ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের ভাগ্যে তেমন একটা জোটেনি। জুটেছিল রিলিফের গম, জুতা, কম্বল, সস্তা দামের মেয়েদের শাড়ি আর ছেলেদের লুঙ্গি। আমাদের প্রজন্ম—যাঁরা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, তাঁদেরকে রিলিফে পাওয়া জিনিসপত্র দিয়ে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। বাড়িতে মা একটা ডিমকে ছয় ভাগ করে আমাদের ভাই-বোনদের পাতে দিতেন। মা কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা জোড়াতালি দিয়ে পরতেন। ঈদে একটা নতুন কাপড় জুটত। তা-ও সবার ভাগ্যে না। শহরের বেশির ভাগ বাড়িতে হারিকেন জ্বলত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রিলিফ শব্দটিই অপরিচিত। বাংলাদেশ বর্তমানে সামান্য পরিমাণে হলেও কোনো কোনো দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আপৎকালীন রিলিফ দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকালে পাকিস্তান মাঝেমধ্যে কোনো দেশকে প্রয়োজনে রিলিফ দিত আর তা ছিল পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত চা। বাংলাদেশের একটি অসাধারণ সাহসী অর্জন হলো নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগা প্রকল্পে হাত দেওয়া। যাত্রার শুরুতে বাংলাদেশ তার বাজেটে ৯০ ভাগ অর্থায়ন করত বিদেশি খয়রাত আর ধারদেনা দিয়ে। বর্তমানে তার উল্টোটা হয়। এটি সম্ভব হয়েছে একজন সাহসী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণে। বর্তমান বাংলাদেশের এত সব অভাবনীয় অর্জন চিন্তাও করতে পারবে না, যদি কেউ দীর্ঘ সময় পর দেশ ফেরে।

বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের কিছু গণমাধ্যম নিয়মিত নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে, যার মধ্যে লন্ডনের ইকোনমিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস অন্যতম। তারা দুর্নীতি, মানবাধিকার, সুশাসন, গণতন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করে। এসব সমালোচনার হয়তো যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু তার পরও তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, বাংলাদেশ গত এক দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এর মধ্যে আছে নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রের বিস্তার ও তাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করাসহ সামাজিক অগ্রগতির অন্যান্য সূচকের উন্নতি। এসব গণমাধ্যম ও অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছে এবং তাঁর নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। গত ৪ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে লিখেছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির একটি এবং সেই অর্থনীতি স্থিতিশীল এবং দেশটির অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই স্থিতিশীলতা টেকসই হবে, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। যে দেশটিকে একসময় বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি, সেই দেশটি বর্তমানে বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য রোল মডেল। বাংলাদেশের সামনে ২০৩৩ সালে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, পরিমাণ হবে ১.০৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার বর্তমান পরিমাণ হচ্ছে ২৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশটি একটি কৃষিনির্ভর দেশ থেকে সরে এসেছে এবং বর্তমানে ছোট ও মাঝারি আকারের শিল্প ও সেবা খাতের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করেছে।’ এর আগে কলকাতার ডেইলি টেলিগ্রাফে গত ৩ এপ্রিল অর্থনৈতিক বিশ্লেষক দেবদূত পুরোহিত লিখেছেন, বাংলাদেশকে তার প্রত্যাশিত গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে তার বিদ্যমান ব্যাধিগুলো দূর করতে হবে, যার মধ্যে দুর্নীতি অন্যতম। এবং এসব কাজ শেখ হাসিনাকেই করতে হবে। কারণ বাংলাদেশে আরেকজন শেখ হাসিনা জন্ম নেবে না।

গত ২২ এপ্রিল আফগানিস্তানের উচ্চশিক্ষা বিষয়ক চার সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। নেতৃত্বে ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য প্রফেসর হামিদুল্লাহ ফারুকি। তিনি আফগানিস্তানে একজন পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করেন। তাঁরা এসেছিলেন দুটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে। প্রথমটি হচ্ছে, কিভাবে বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশের নারীশিক্ষার এমন চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন কী উপায়ে সম্ভব হয়েছে। প্রথমটি সম্পর্কে বলেছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে কটি অসাধারণ কাজের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণ আর তা করার জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে দেশের চারটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি সব সময় শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের শিক্ষাবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, আমলাদের নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে তিনি একই বছর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, যার পরিচালনা তিনি সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেছিলেন শিক্ষাবিদদের ওপর। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর আমলে প্রণীত এসব আইনকে ছিনতাই করার অনেক চেষ্টা হয়েছে এবং সে প্রচেষ্টা এখনো বলবৎ আছে। তবে তা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কারণ এসব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষকসমাজ রুখে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকেও অনেকবার আমলাতান্ত্রিক করার চেষ্টা হয়েছে, তা-ও ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার চিন্তাধারাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জানতে চান, তাঁদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের মডেলে উন্নত করতে হলে তারা কী করতে পারেন। তাঁদের ঠাট্টা করে বলেছি, তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার প্রয়োজন। বলেছি, পলিসি লেভেলে পরিবর্তন না হলে নিচের লেভেলে কিছুই হবে না।

এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা এ জন্যই প্রয়োজন, যাতে বর্তমান প্রজন্ম বুঝতে পারে, তাদের পূর্বসূরিরা কোথায় ছিলেন, তারা নিজেরা বর্তমানে কোথায় আছে এবং আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ার জন্য তারা কী ভূমিকা রাখতে পারে। এ-ও বোঝানো যে একটি দেশের সঠিক নেতৃত্ব দেশটিকে কোন জায়গা থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত